বাংলাদেশে নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং আইনগত মর্যাদা আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশে নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আইনগত মর্যাদা বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আইনগত মর্যাদা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশে নারীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আইনগত বিষয়সমূহ তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশের নারীরা পৃথক কোনো শ্রেণি নয়, বরং গোটা মানবজাতিরই একটা উল্লেখযোগ্য অংশ। কিন্তু মানবজাতির এ উল্লেখযোগ্য অংশ ঐতিহাসিকভাবেই নানা ধরনের শোষণ নিপীড়নের শিকার। জীবনের সকল স্তরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান ও মর্যাদা পুরুষের তুলনায় অধস্তন। তবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রায় চার দশকের পথ পরিক্রমায় এ দেশের সমাজব্যবস্থায় নারীর অবস্থান কি বা কোথায় এবং নারীরা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থাৎ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইনগত প্রভৃতি থেকে নারীকে যেসব।মর্যাদা ও অধিকার দেয়া হয়েছে তা আলোচনার মাধ্যমে জানা সম্ভব। নিম্নে নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং আইনগত মর্যাদা আলোচনা করা হলো :
শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা : শিক্ষা একটি মানবিক অধিকার এবং সমতা, উন্নয়ন ও প্রগতির লক্ষ্য অর্জনে এক অপরিহার্য হাতিয়ার। শিক্ষা মানুষের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে এবং দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটায়। কিন্তু বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আর শিক্ষাহীনতার কারণেই নারীদের সামাজিক অবস্থান অধস্তন বা নিচু। বাংলাদেশে নারীরা ঐতিহাসিক ভাবেই শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এর প্রধান কারণ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, বাল্যবিবাহ, সন্তান ধারণ, সাংসারিক কাজের চাপ, জেন্ডার পক্ষপাতিত্ব, স্কুলের দূরত্ব ইত্যাদি। একটি দেশের উন্নয়ন সে দেশের নারী সমাজের উন্নয়নের উপর নির্ভরশীল। আর নারী সমাজের উন্নয়ন সম্ভব শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে। তাই এ দেশের সমাজব্যবস্থার সার্বিক বিকাশের স্বার্থে নারী শিক্ষাকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বাংলাদেশে নারী সাক্ষরতার হার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবে তা পুরুষের তুলনায় কম। বর্তমানে নারী পুরুষের সাক্ষরতার তারতম্য গ্রাম থেকে শহরে বেশি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলাদেশের শিশুদের আনুষ্ঠানিক হাতে খড়ি হয়। স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তির সংখ্যা হিসাব করলে দেখা যায়। ১৯৯০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র ও ছাত্রীর অংশগ্রহণ যথাক্রমে ৫৫.৩ শতাংশ এবং ৪৪.৭ শতাংশ। আবার ২০০২ সালে ছাত্র ছাত্রীর এ হার যথাক্রমে ৫০.৩ শতাংশ ও ৪৯.৭ শতাংশে দাঁড়ায়। তাই দেখা যাচ্ছে প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে ছাত্রী ভর্তির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। উচ্চতর পর্যায়ে নারী শিক্ষার চিত্রটি বেশ নৈরাশ্যজনক। গত ১০ বছরে নারী শিক্ষার হার কিছুটা বেশি। কিন্তু উচ্চস্তরে তা আর থাকছে না। তাই নারী শিক্ষা গ্রহণের হার বাড়লেও বৃদ্ধির হার অত্যন্ত কম। বাংলাদেশ সরকার নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সরকার একটি অভিন্ন গণমুখী এবং সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার জন্য বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা প্রবর্তন করেছে। তাছাড়া বর্তমান সরকার দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের উপবৃত্তি ও অবৈতনিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। তথাপি উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণের হার খুবই কম। তাই সমাজে নারীর অবস্থানকে সুদৃঢ় করার জন্য নারীকে অবশ্যই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা : স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান খুবই হতাশাজনক। দেশের সব মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সাংবিধানিক অঙ্গীকার হলেও বাস্তব সত্য হলো এখনো নারীরা স্বাস্থ্যসেবার অধিকার থেকে বঞ্চিত । এমনকি স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যে নারীর অধিকার এটাও জানা নেই অনেকের। তাই এদেশের পুরুষের তুলনায় নারীর স্বাস্থ্য পরিচর্যা অনেক কম হয়। দারিদ্র্য, অভাব, খাদ্যের অপর্যাপ্ততা, পুষ্টির স্বল্পতা, বাল্যবিবাহ, অল্প বয়সে সন্তান ধারণ বহু সন্তানের জন্মদান ইত্যাদি কারণে নারীরা বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতার শিকার হয়। বাংলাদেশের ৭০% নারী পুষ্টিহীনতায় ভোগেন। বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে একজন পুরুষ গড়ে প্রতিদিন ২,২৯৯ ক্যালরি গ্রহণ করেন, আর একজন নারী গ্রহণ করেন গড়ে ১,৮৪৯ ক্যালরি। বাংলাদেশের একজন গৃহবধূ পরিবারের সবার শেষে এবং সর্বশেষ তলানিটুকু আহার হিসেবে গ্রহণ করেন। এ ব্যবস্থা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ধারণ ও বাহককে পুষ্টিহীন করে ফেলেছে। এ রীতি অনুযায়ী মেয়ে শিশু জন্মের পর থেকে একজন নারী হিসেবে পরিবারে দ্বিতীয় শ্রেণির স্বীকৃতি পান। চিকিৎসা সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের মধ্যে চরম বৈষম্য বিদ্যমান। মুমূর্ষু অবস্থা ছাড়া কোনো নারীকেই চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল বা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় না। নারীদের অসুস্থতা একেবারেই গুরুত্বহীন। তাছাড়া নারীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাও দুর্বল । হাসপাতালে নারীদের তুলনায় পুরুষের শয্যা সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশের নারীরাই মূলত জন্ম শাসন পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। যা পরবর্তীতে নারীর বিভিন্ন জটিল রোগের কারণ
হয়ে দাঁড়ায় । বাংলাদেশের মায়েরা যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পান না বলে তারা বিকলাঙ্গ ও কম ওজনের শিশু জন্ম দেয়। বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ শিশু জন্মায় কম ওজনে এবং প্রতি হাজারে ৫টি শিশুর মৃত্যু হয় জন্মের সময় পুষ্টিহীনতার কারণে । সুতরাং বলা যায়, যতদিন নারী স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে, ততদিন নারীরা সামাজিক মর্যাদার দিক থেকেও পিছিয়ে থাকবে। তাই নারীদের সামাজিক অবস্থান নির্ণয়ের জন্য অধিকার ভিত্তিক একটি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নারী সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে নারীর স্বাস্থ্যগত মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্নমুখী কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে।
নারীর আইনগত মর্যাদা : বাংলাদেশের আইনগত কাঠামোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এখানে নারীর অবস্থানকে প্রান্তিক হিসেবেই মূল্যায়ন করা হয়। আইনে নারীকে একজন পূর্ণ ব্যক্তি বা পূর্ণ নাগরিকের মর্যাদা থেকে দূরে রেখে সমাজে নারীর অধস্তনতাকে আরও বেশি সুদৃঢ় করা হয়। জাতি, বর্ণ, নির্বিশেষে এদেশের যে নাগরিক আইন (Civil Law) ও ধর্ম, বর্ণ, নিয়মের ভিত্তিতে প্রচলিত যে ব্যক্তিক আইন প্রচলিত আছে সেগুলোতে নারীর মর্যাদা পুরুষের চেয়ে নিম্নতর। এক্ষেত্রে সংবিধানে নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দেবার বিষয়টি স্বীকার করা হলেও; আইন প্রতিষ্ঠা ও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার হতে বঞ্চিত। সংবিধানে লিঙ্গ, শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য সমান
অধিকারের যে অঙ্গীকার ঘোষণা করেছে। তার অর্থ হয় এটিই যে, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক পর্যায়ে নারী- পুরুষের বৈষম্যমূলক আইন রাষ্ট্র গ্রহণ করবে না। কিন্তু রাষ্ট্রের ‘সংবিধানে এ অঙ্গীকার সত্ত্বেও বৈষম্যমূলক সবরকম আইনকে বহাল রেখেছে। যার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ধর্মীয় আইন। একই সাথে সংবিধান প্রদত্ত অধিকারের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ পারিবারিক আইনসমূহ বহাল রয়েছে। এসব আইনে নারী-পুরুষ বৈষম্যমূলক বিধিবিধান ‘সমঅধিকার’ শব্দ সম্বলিত সংবিধানের ঘোষণাকে অর্থহীন করে তুলেছে। ব্যক্তিক আইন বা পারিবারিক আইনের মধ্যে রয়েছে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, বহুবিবাহ, দেনমোহর, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব ও সন্তান লালনপালন, উত্তরাধিকার ইত্যাদি। বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্ রিস্টান জনগোষ্ঠী এ সকল বিষয়ে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় আইন দ্বারা পরিচালিত হন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণেই নারীরা পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় পশ্চাৎপদ। তাই বাংলাদেশে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় একজন নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইনগত অর্থাৎ যে অধিকারই আলোচনা করা হোক; এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। পুরুষের সাথে তুলনামূলক বিচারে তাতে অনেক বৈষম্য রয়েছে। অথচ বাংলাদেশ সংবিধানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নারী-পুরুষকে মর্যাদা ও সমঅধিকার প্রদান করেছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে মর্যাদা ও অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে নারীরা বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%be-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf/