প্রশ্নঃ বাংলাদেশে কৃষি যাত্রিকীকরণের সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ আলোচনা কর ।
উত্তর ৷ ভূমিকা : বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে । আমাদের দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের যেসব অসুবিধা রয়েছে তা দূর করা কঠিন হলেও একেবারে অসম্ভব নয় । জোতের আয়তন ছোট বলে যন্ত্র ব্যবহার করার হে অসুবিধা তা সমতায় চাষ প্রবর্তন করে দূর করা যায় । সমবায় সমিতির মাধ্যমে মূলধন সমস্যারও সমাধান সম্ভব । বাংলাদেশের কৃষকদেরকে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারও শিক্ষা দিতে হবে । একথা অনস্বীকার্য যে , যন্ত্রপাতির ব্যবহার শিক্ষা দিতে যথেষ্ট সময় লাগবে , কিন্তু ভবিষ্যতে কৃষক একদিন এ যন্ত্রপাতির যথাযথ শিখবে ।
বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ : কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে বহু লোক বেকার হয়ে পড়বে । এক হিসাব মতে , বাংলাদেশে কৃষির ব্যাপক যান্ত্রিকীকরণ করা হলে শতকরা ৬০ ভাগ লোক কর্মচ্যুত হয়ে পড়বে । কিন্তু দেশে দ্রুত হারে শিল্পের সম্প্রসারণ হচ্ছে না বলে এসব কর্মচ্যুত ব্যক্তির জন্য অবিলম্বে শিল্পক্ষেত্রে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে না । সুতরাং আমাদের দেশে অবিলম্বে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ না করে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি হিসেবে একে ধীরে ধীরে গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয় । এ কারণে পূর্ণ যান্ত্রিকীকরণ না করে ছোট ছোট হালকা যন্ত্রপাতি , উন্নত সেচ ব্যবস্থা , কর্ষণযোগ্য পতিত জমি পুনরুদ্ধার এবং উন্নত বীজ ও সার ব্যবহার করে জমির উৎপাদন বৃদ্ধি করা দরকার । নিম্নে বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. ফসল বহুমুখীকরণ : আমাদের দেশে ৪৫.৯ লক্ষ হেক্টর এক ফসলি জমি আছে । জল সেচ ও জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে এসব জমিতে একাধিক ফসলের চাষ করা সম্ভব । উল্লেখ্য যে , আমাদের দেশের মোট আবাদযোগ্য জমির অর্ধেকই এক ফসলি জমি ।
২. ইরি ও বোরো ধানের উৎপাদন : ইরি ও বোরো এ দুটি অত্যন্ত উচ্চ ফলনশীল ধান । এ দু’প্রকার ধান উৎপাদনের জন্য জমিতে সবসময়ের জন্য যথেষ্ট পানি সেচের ব্যবস্থা করা অতি দুরূহ । তাই বিভি প্রকার ধান উৎপাদনের জন্য কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার অপরিহার্য ।
৩. অনাবাদি জমি চাষ : বাংলাদেশে প্রায় ৪০.৮ লক্ষ একর অনাবাদি জমি রয়েছে । এসব জমি চাষাধীনে আনতে হলে অবশ্যই কৃষি যন্ত্রপাতির সাহায্য নিতে হবে । যান্ত্রিক পদ্ধতি ছাড়া অনাবাদি জমি চাষাধীনে আনা কঠিন । এছাড়া বাংলাদেশে এখনো অনেক অসমতল ও পাহাড়ি অঞ্চল রয়েছে , যেখানে বর্তমানে কোন ফসলই উৎপন্ন হয় না । এরূপ জমির পরিমাণ আমাদের দেশে প্রায় ২৬.৬ লক্ষ হেক্টর । এসব অঞ্চলের জমিকে যন্ত্রের সাহায্যে সমতল করে ফসল উৎপাদন করা সম্ভব ।
৪. বিল ও হাওর এলাকায় চাষাবাদ : বাংলাদেশে অনেক জেলায় বিল ও হাওর আছে যেখানে প্রায় সারা বছরই পানি জমে থাকে । দেশে এরূপ জলাভূমির পরিমাণ প্রায় ৩০.৭ লক্ষ হেক্টর । বিশেষ করে নেত্রকোনা , কিশোরগঞ্জ ও বৃহত্তর সিলেট জেলার হাওর এলাকায় এখনো হাজার হাজার হেক্টর জমি পতিত পড়ে আছে । শক্তিচালিত পাম্প ব্যবহার করে পানি নিষ্কাশনের মাধ্যমে এসব এলাকায় প্রচুর শস্য উৎপাদন করা যায় ।
৫. বৃহদায়তন সমবায় খামার : বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষকেরা ক্ষুদ্রায়তন কৃষিজাতের অসুবিধা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সমবায়ভিত্তিক বৃহদায়তন কৃষি খামার ব্যবস্থা প্রবর্তনে আগ্রহান্বিত । বাংলাদেশের অনেক এলাকায় সমবায় কৃষি খামার ব্যবস্থা চালু হয়েছে । এরূপ বৃহদায়তন কৃষি খামার হতে সর্বাধিক সুফল পেতে হলে অবশ্যই যান্ত্রিক কৃষি পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে ।
৬. শুঙ্ক ঋতুতে চাষাবাদ : বাংলাদেশে শুষ্ক ঋতুতে জমি চাষের জন্য সহজেই কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যেতে পারে । কারণ এ সময় মাটি শুষ্ক ও নরম থাকে বলে কৃষি যন্ত্রপাতি সহজে ব্যবহার করা যায় ।
৭. বন্যা নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে অন্যতম একটি প্রধান সমস্যা হলো বন্যা সমস্যা । বাংলাদেশে বন্যায় প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকার ফসল নষ্ট হয় । বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা কৃষির যান্ত্রিকীকরণের মধ্যে পড়ে । সুতরাং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ , নদী খনন প্রভৃতি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে , বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনা আলোচনা করে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে , দ্রুত শিল্পোন্নয়নের মাধ্যমে কর্মচ্যুত কৃষকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে বড় বড় ট্রাক্টর ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে অবিলম্বে কৃষি বিপ্লব ঘটালে নতুন জটিলতার সৃষ্টি হবে । এক্ষেত্রে কৃষির দ্রুত যান্ত্রিকীকরণ করতে চাইলে কৃষিতে কর্মচ্যুত শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে । সুতরাং বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কৃষি পদ্ধতিতে পূর্ণ যান্ত্রিকীকরণের পরিবর্তে উপর্যুক্ত আংশিক যান্ত্রিকীকরণের ব্যবস্থা করাই বাঞ্ছনীয় ।