বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কি অপরিহার্য ছিল? এ যুদ্ধে কী প্রমাণিত হয়? আলোচনা কর।

উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৪৭ সালে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জন্য মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। ফলে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারতবর্ষে পাকিস্তান (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) নামে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠি হয়। যদিও পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবধান ছিল প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার। পাকিস্তানের এ দুই অংশের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জীবন জীবিকা, লোকাচার ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। যার ফলে এ দুই অঞ্চলের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য করতে থাকে। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণ নিজেদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য এক রক্তক্ষয়ী বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে এবং ছিনিয়ে আনে নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অপরিহার্যতা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেন অপরিহার্য ছিল, তার এক কথায় উত্তর দেওয়া যেতে পারে যে বৈষম্য। যে বৈষম্যগুলোর কারণে বাঙালি আর ঘরে বসে থাকতে পারেনি, ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধে। নিচে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অপরিহার্যতার পিছনে যে বৈষম্যগুলো বিদ্যমান ছিল তা আলোচনা করা হলো :
ক. সাংস্কৃতিক বৈষম্য : সর্বপ্রথম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আঘাত হানে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর। পাকিস্তান সৃষ্টির পরই নিখিল পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়। এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। এতে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ভাষা দিবস পালন ও দেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে ২১ ফেব্রুয়ারি উক্ত কর্মসূচিকে বানচাল করার জন্য তৎকালীন গভর্নর নুরুল আমীন ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। কিন্তু জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করে। পাশাপাশি পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকরা অবগত হয় যে, বাঙালি তার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবনকে তুচ্ছ মনে করে। ছাত্র জনতার এ আত্মত্যাগ বাঙালি জাতির আন্দোলনের প্রথম সোপান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
খ. অর্থনৈতিক বৈষম্য : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ভারতবর্ষ থেকে বিভক্ত হওয়ায় পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যবধানের মাত্রা ছিল খুব কম। চা উৎপাদন এবং বস্ত্র উৎপাদনে পূর্ব পাকিস্তান সামান্য এগিয়ে ছিল। যদিও চিনি এবং ধাতব দ্রব্যের উৎপাদন ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু বেশি সুবিধা ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সেচ
পরিকল্পনা ছিল উন্নততর। কিন্তু ব্যাংক ব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের সুযোগ ছিল বেশি। মোটামুটি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের দুইঅংশ একই পর্যায়ে ছিল। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে বেশি ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা .. যায়, ১৯৪৯-৫০ অর্থবছরে পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল যথাক্রমে ৩৩৮ টাকা এবং ২৮৭ পরবর্তী সময়ে সরকারি বৈষম্যের ফলে পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে বৈষম্যের পাহাড় গড়ে উঠে। উদাহরণস্বরূপ বলা টাকা অথচ ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ৫৩৩ টাকা এবং ৩৩১ টাকা অর্থাৎ বৈষম্য গিয়ে দাঁড়ায় ৬১% এ। এছাড়াও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অন্যান্য বৈষম্য ছিল নিম্নরূপ :
১. ব্যয় দ্বিগুণ : পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় করা হতো। দেশের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান এর সম প্রাপ্তির অধিকারী ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এক্ষেত্রে বৈষম্য প্রদর্শন করেছিল।
২. পশ্চিম পাকিস্তানে বিনিয়োগ বৃদ্ধি : দেশের সম্পদ ও বৈদেশিক সাহায্যের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে বিনিয়োগ করে শিল্পকারখানা, কৃষি, সেচ, ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রভূত উন্নয়ন করা হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ করে অনাবাদি বিশাল অঞ্চলকে শস্যভাণ্ডারে পরিণত করা হয়।
৩. রাজস্ব উন্নয়ন বাজেটে বৈষম্য : পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবসায় বাণিজ্যের সমুদয় কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীভূত করে সেখানকার উন্নয়নে মনোযোগী হয়। তারা রাজস্ব উন্নয়ন বাজেটের উভয় অংশের মধ্যে মারাত্মক বৈষম্য করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানের মোট উন্নয়ন ব্যয় ছিল ৬,১৯৮ কোটি টাকা সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ছিল মাত্র ২,৯৯৬ কোটি টাকা।
৪. জনগণের জীবনমান ও মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য : পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে শিল্পায়ন ও জনগণের জীবনমান ও মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধি পায় মূলত উভয় অংশের শিল্প প্রতিষ্ঠায় বৈষম্যমূলক নীতির জন্য। এছাড়াও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত অর্থনৈতিক বঞ্চনামূলক নীতি গ্রহণের ফলে দুই অঞ্চলের মধ্যে বিরাজমান অর্থনৈতিক বৈষম্য এত প্রকট হয়ে উঠে যে, সাধারণ বাঙালিরা পর্যন্ত এ অবস্থার প্রতিকারের জন্য সোচ্চার হয়ে উঠে। এর ফলেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পিছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। আর এ থেকেই সূচিত হয় বিপ্লবের এবং জন্ম হয় বাংলাদেশের।
গ. রাজনৈতিক বৈষম্য : পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের অব্যবহিত পরেই পূর্ব বাংলা রাজনৈতিক বৈষম্যের সূচনা হয়। তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃত্বে। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের উদীয়মান নেতা এবং অভিজ্ঞ নেতাদের দমিয়ে রাখার কৌশল গ্রহণ করা হয়। জনসংখ্যার দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তান
সংখ্যাধিক্য হওয়া সত্ত্বেও প্রায় সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হয়। এমনকি আইন পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনৈতিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আন্তরিকতা এবং সহযোগিতা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, নির্যাতন আর বঞ্চনার জন্য এদেশের মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের এসব বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদে যখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের দাবি তোলে, তখন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্র গণতান্ত্রিক রীতিনীতির কথা ভুলে গিয়ে ন্যায্য দাবিদাওয়াকে দমানোর চেষ্টা শুরু করে।
ঘ. সামরিক বৈষম্য : সামরিক ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার বৈষম্য ছিল সীমাহীন। পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল একেবারে নগণ্য। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ৩টি সদর দপ্তরই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সমরাস্ত্র কারখানাও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে । সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে বাঙালিদের কোনো স্থান ছিল না। এমনকি সামরিক বাহিনীতে চাকরির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গ একচেটিয়া আয়ত্ত নীতি গ্রহণ করে। কেবল সেনাবাহিনীতেই পশ্চিম পাকিস্তানের স্থান ছিল শতকরা ৯৫ ভাগ, পূর্ব পাকিস্তানের স্থান ছিল মাত্র ৫ ভাগ। প্রতিরক্ষা খাতের মোট বাজেটের ৯৫% ব্যয় করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যয় করা হতো মাত্র ৫%। এভাবে বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক বৈষম্য শুরু পূর্ব পাকি স্তানের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিপ্লব দানা বাঁধতে থাকে এবং এরই সূত্র ধরে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার জাগরণ সৃষ্টি হয়। যা পরবর্তীতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে পূর্ব বাংলার জনগণের জন্য স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম অপরিহার্য ছিল এবং এ যুদ্ধ এটাই প্রমাণ করে জোর করে যে, অন্যায়ভাবে বাঙালিকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলাদেশের।