অথবা, বাংলাদেশের সুশাসনের বাধাগুলো আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের সুশাসনের ত্রুটিগুলো বিশ্লেষণ কর।
অথবা, বাংলাদেশে সুশাসনের অন্তরায়গুলো সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি অনুন্নত দেশ। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের তুলনায় অনেক পশ্চাৎপদ। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় পিছিয়ে। জনসংখ্যাধিক্য, অশিক্ষা ও দারিদ্র্যের সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশের যে কোনো সরকারের পক্ষেই সার্বিক সাফল্য অর্জন করা অসম্ভব ব্যাপার। সরকার গঠনে জনগণের অংশগ্রহণ, সরকার গঠনের বৈধতা, সরকারের সমর্থনের বৈধতা, আইনের শাসন, সাংবিধানিকতা, শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক, সরকার বদল ও বিরোধী দলের সম্পর্ক ইত্যাদি বিচারবিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্রের সুপরিচালনা কার্য নির্ভর করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুশাসনের সমস্যা : নিম্নে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুশাসনের সমস্যাগুলো আলোচনা করা হলো :
১. সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশে সরকারের কর্মকাণ্ডের কোনো প্রকার আলোচনা বা সমালোচনা তা গঠনমূলক হোক বা না হোক তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। জনগণ বা প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু সীমানা অতিক্রম করা ‘Governance’ এর ধারণাকে সংকুচিত করে। সাধারণত গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করে না। সরকারের অ্যাচিত হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ সুশাসনকে বিঘ্নিত করে ।
২. বাঙালি ও উপজাতি সংঘাত : বাংলাদেশের প্রাথমিক পর্যায়ে সরকার উপজাতীয়দের বাঙালিতে পরিণত করতে গিয়ে তাদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তার জের অদ্যাবধি চলছে। পরবর্তীতে একাধিক সরকার উপজাতীয়দের বাসস্থানসমূহে ছিন্নমূল বাঙালি পুনর্বাসন করতে গিয়ে এ সমস্যাকে জটিল করে তুলেছে। বাঙালি-উপজাতি সংঘাত ও সংঘর্ষের ফলে দীর্ঘদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংস পরিবেশ বিদ্যমান থাকায় একদিকে যেমন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও
অস্থিতিশীললতা সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি উন্নয়নের গতিধারা ব্যাহত হয়েছে। সুশাসন সক্ষম সরকার ব্যবস্থার সঠিক প্রতিষ্ঠারূপ
রক্তঘাতী সংঘর্ষে চিরতরে বিলুপ্ত করে স্থায়ী শান্তি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে।
৩. একাধিকবার সেনা অভ্যুত্থান : বাংলাদেশের সামাজিক দুর্নীতি, অনাচার, অবিচার, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি কারণে চরম
বিপর্যয়ে জনগণের অসহায়ত্বের সুযোগে এবং সরকারের ব্যর্থতার সুযোগে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। সেনাবাহিনী কখনও জনগণের প্রতিনিধি নয় ফলে জনস্বার্থে প্রশাসন পরিচালনা করা তাদের কাছে আশা করা যায় না। স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশে একাধিকবার সামরিক অভ্যুত্থান, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল, সরকার গঠন, সরকার পরিচালনা এসব বিষয়ই সুপরিচালনা বহির্ভূত বিষয় ।
৪. সরকার ও বিরোধী দলের সহিষ্ণুতার অভাব : উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে যেখানে সরকারি দল ও বিরোধী দল ছায়ার মতো জাতীয় স্বার্থের নিমিত্তে পরস্পরের সাথে মিলিত থেকে কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশের
দলীয় ব্যবস্থা এরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দলীয় নেতৃবৃন্দ সবসময়ই ব্যর্থ হয়েছে যা বাংলাদেশ পরিচালনায় এসব বিষয়েই সুপরিচালনা বহির্ভূত বিষয়।
৫. জবাবদিহিতার অভাব : বাংলাদেশে আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলে সুপরিচালনার সংকট থেকে সরকার রেহাই পেতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশ সরকার এসব প্রতিষ্ঠানসমূহ সঠিকভাবে তাদের কার্যক্রম জনগণের সামনে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়নি বিধায় তাদের ব্যর্থতা ও সফলতার পরিমাণ নির্ধারিত হয়নি। একটি রাষ্ট্রের সঠিক কার্য পরিচালনার উপর সরকারের সুপরিচালনা নির্ভর করে।
৬. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতি : আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর চরম দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা, সুশৃঙ্খলতা বাংলাদেশের জনগণের রাষ্ট্রীয় জীবনের শান্তি নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে যে অরাজকতাময় অবস্থার সূত্রপাত করেছে সে পরিস্থিতি সুশাসনের পরিপূর্ণ প্রতিকূল। সভ্যতার ইতিহাসে বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীতে যেখানে কল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণা বিশ্বব্যাপী, সেখানে পুলিশ হেফাজতে মানুষের নির্বিচার মৃত্যু, একটা দেশের সরকার ব্যবস্থার চরম অব্যবস্থার কথাই স্মরণ করে দেয়।
৭. গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ : বাংলাদেশের প্রাথমিক রাজনৈতিক জীবনে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে যে সময়ের প্রয়োজন তিনি সে সময় পাননি। সংগত কারণেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সে সময়কার বিরাজমান অস্থির রাজনীতি, গুপ্ত রাজনৈতিক পরিবেশে সফলতা আনতে পারেনি। বিরাজমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অর্থাৎ সুখী, সমৃদ্ধ তথা সোনার বাংলা গড়ার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয়
রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা প্রবর্তনে বাধ্য হন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মতো সমস্যাসংকুল, অশিক্ষার অভিশাপে অভিশপ্ত, দারিদ্র্যপীড়িত বিপুল জনগোষ্ঠীকে সুপরিচালনার আওতায় আনতে হলে জনগোষ্ঠীকে বিবেকবান, দায়িত্বশীল, সুশিক্ষিত ও সচেতন করে গড়ে তোলার প্রয়োজন। এ বিপুল বিশৃঙ্খল জনগোষ্ঠীকে সুসংগঠিতভাবে পরিচালনা করা যে কোনো সরকারের পক্ষেই অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। জনগণ ও সরকার পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পালনে সক্ষম হন।