আমলাতন্ত্র কাকে বলে? আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর ।

অথবা, আমলাতন্ত্র বলতে কী বুঝ? আমলাতন্ত্রের বিশেষত্বগুলো বর্ণনা কর।
অথবা, আমলাতন্ত্রের সংজ্ঞা দাও।
অথবা, আমলাতন্ত্র কী? আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, আমলাতন্ত্র কাকে আমলাতন্ত্রের যে সকল বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় তা লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভবের সাথে সাথেই আমলাতন্ত্রের বিকাশ ও কার্যাবলি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে? আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলোর বিবরণ দাও। এবং এটি একটি সর্বজনীন ধারণায় পরিণত হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সকল সরকারি ব্যবস্থাই হলো কোনো না কোনো আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নামান্তর।
আমলাতন্ত্র : সাধারণত রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত কর্মচারীরা আমলা নামে পরিচিত এবং এদের দ্বারা পরিচালিত প্রশাসনিক ব্যবস্থাই হলো আমলাতন্ত্র। অন্যভাবে বলা যায়, আমলাতন্ত্র এক বিশেষ ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা যা নিয়মকানুনের ভিত্তিতে সংগঠিত হয় এবং এর মধ্যে বর্তমান থাকে বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তর। এছাড়া এ ব্যবস্থায় ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও পদমর্যাদার ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিন্যাস থাকে ।
ব্যুৎপত্তিগত অর্থ : ইংরেজি ‘Bureaucracy’ শব্দটি ফরাসি শব্দ ‘Bureau’ এবং গ্রিক শব্দ ‘Kratein’ এ দুটি শব্দ হতে উদ্ভূত হয়েছে। ‘Bureau’ অর্থ দফতর এবং ‘Kratein’ অর্থ ‘শাসনব্যবস্থা’। সুতরাং ‘Bureaucracy’ বলতে
দফতরনির্ভর শাসনব্যবস্থাকে বুঝায়। অর্থাৎ আমলাতন্ত্র বলতে নিযুক্ত কর্মচারীগণের এক বৃহদায়তন সংগঠনকে বুঝায়, যারা সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সুব্যবস্থিতভাবে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত থেকে কাজ করে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : অধ্যাপক ফিফানার ও প্রেসথাস (Prof. Pfiffner & Presthus) এর মতে, “আমলাতন্ত্র হচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও তাদের কর্মকাণ্ডকে এমন এক পদ্ধতিতে সংগঠিত করা, যা সুসংহতভাবে গোষ্ঠী শ্রমের উদ্দেশ্য অর্জনে সক্ষম হয়।” (Bureaucracy is the systematic organization of tasks and individuals into a pattern which can effectively attain the end of group effort.) অধ্যাপক হারম্যান ফাইনার (Prof. Herman Finer) এর মতে, “The civil service is a body of officials
permanent, paid and skilled.”
কার্ল মার্কস (Karl Marx) এর মতে, “আমলাতন্ত্র হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের সংগঠন এবং সরকারি প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে এটা একটি সাধারণ পদ্ধতি।”
অধ্যাপক গার্নার (Prof. Garner) বলেছেন, “এককথায় সরকারের সিদ্ধান্ত ও নীতিমালা নির্ধারণে এবং সাধারণভাবে সরকার পরিচালনায় নিয়োজিত কর্মচারীগণই আমলা নামে অভিহিত।”
অধ্যাপক ফাইনার (Prof. Finer) এর মতে, “আমলাতন্ত্র হচ্ছে একটি স্থায়ী বেতনভুক্ত এবং দক্ষ চাকরিজীবী শ্রেণি ।” আমলাতন্ত্রের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেছেন সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber)। তিনি বলেন, “আমলাতন্ত্র এমন একটি সংগঠন যার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম রয়েছে, যার কার্যাবলি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে
সমাধা হয় এবং যেখানে ক্ষমতা ব্যবহারের নির্দিষ্ট পর্যায়ক্রমে বিশিষ্ট একটি কাঠামো আছে। যার অধীনস্থ কর্মরত সকল
কর্মচারীই স্থায়ীভাবে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালনে ব্যস্ত থাকে।” উপর্যুক্ত সংজ্ঞার আলোকে বলা যায় যে, আমলাতন্ত্র বলতে সরকারি স্থায়ী বেতনভুক্ত কর্মচারীর সমষ্টিকে বুঝায়, যারা উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিযুক্ত এবং তারা নীতিনির্ধারণ থেকে শুরু করে নীতিগুলোকে বাস্তবে কার্যকরী করে থাকে।
আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ : আমলাতন্ত্রের সঠিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে জার্মান দার্শনিক ম্যাক্স ওয়েবারের অবদানই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। তাঁর দেয়া বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. কার্যক্রম বণ্টন : আমলাতান্ত্রিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মকে অফিসের দৈনন্দিন কর্তব্যরত কর্মচারীদের মধ্যে নির্দিষ্টভাবে বণ্টন করে দেয়া হয়। এ সংগঠনের অফিসের কার্যাবলি নিরবচ্ছিন্নভাবে আইন দ্বারা পরিচালিত হয়।
২. কর্মপরিধি নির্ধারণ : আমলাতান্ত্রিক সংগঠনে কর্মচারীদের সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। এতে প্রত্যেক কর্মচারীকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কার্যসম্পাদন করতে হয়। সম্পাদিত কার্যাবলির জন্য তাদেরকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রিদের নিকট দায়িত্বশীল থাকতে হয়।
৩. সুপ্রতিষ্ঠিত বিধিবিধান : আমলাতান্ত্রিক সংগঠনে প্রশাসনিক কার্যসমূহ পরিচালনার জন্য সুপ্রতিষ্ঠিত বিধিবিধান রয়েছে। সংগঠনের নীতিসমূহ নির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকে এবং কর্মচারীগণ এসব বিধিবিধান মেনে চলেন। কর্মচারীদের বিধিবিধান ভঙ্গের জন্য শাস্তি পেতে হয়।
৪. অফিস এবং ব্যক্তিগত সম্পদের মধ্যে পার্থক্য : আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের উৎপাদন বা প্রশাসনিক হাতিয়ারের মালিকানা হতে পৃথক থাকতে হয়। সংগঠনের সম্পত্তি ও কর্মচারীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মধ্যে সম্পূর্ণভাবে পার্থক্য বিরাজ করে।
৫. পদসোপান নীতি : আমলাতান্ত্রিক সংগঠন পদসোপান নীতি অনুসরণ করে থাকে। অর্থাৎ এ সংগঠনে ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন সম্পর্ক বিরাজ করে। এর ফলে অধস্তন অফিসকে ঊর্ধ্বতন অফিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
৬. লিখিত বিধিবিধান : আমলাতান্ত্রিক সংগঠনেও প্রশাসনিক কার্যসমূহ, সিদ্ধান্ত এবং বিধিবিধান লিখিতভাবে রেকর্ড করা হয় এবং উপস্থাপন করা হয়। এ রীতি সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বস্তুত লিখিত বিধান ও অফিসের কার্যাবলি অফিস নামক একটি সংস্থায় সংগঠিত হয়, যা সকল প্রকার আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের প্রধান লক্ষ্য।
৭. কর্ম বিভক্তিকরণ নীতি : আমলাতান্ত্রিক সংগঠন কর্ম বিভক্তিকরণ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। কর্মচারীদের মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মসম্পাদনের জন্য বাছাই করা হয়।
৮. পদমর্যাদা ভোগ ও ব্যবহারের অনুপস্থিতি : আমলাতান্ত্রিক সংগঠনে কর্মচারীগণ কর্তৃক তাদের অফিসের পদমর্যাদা ভোগ ও ব্যবহারের অনুপস্থিতি বিদ্যমান।
৯. স্থায়িত্ব : পদের স্থায়িত্ব আমলাতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সরকারি কর্মচারীগণ একটি নির্দিষ্ট বয়ঃসীমা পর্যন্ত স্থায়ী পদের অধিকারী। সরকারের পরিবর্তনশীলতা সরকারি কর্মচারীদের চাকরির স্থায়িত্বকে কোনো ক্রমেই প্রভাবিত করতে পারে না।
১০. নিয়োগনীতি : আমলাতান্ত্রিক সংগঠনে বিশেষ নিয়মনীতির মাধ্যমে কর্মচারী নিয়োগ করা হয়। আমলাতন্ত্রের প্রতিটি সদস্যই বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী। লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের যোগ্যতা যাচাই করে নেয়া হয়।
১১. ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীন : আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের প্রতিটি অফিস বা পদ একটি পারস্পরিক স্বাধীন চুক্তির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। এ স্বাধীন চুক্তি স্বাধীন নিয়োগ সম্ভব করে। ফলে কর্মচারীগণ ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীন, কিন্তু অফিসের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নিকট দায়ী থাকেন ।
১২. নিরপেক্ষতা : নিরপেক্ষতা আমলাতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যে রাজনৈতিক দলই শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করুক না কেন, আমলাদের সে দলীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করতে হয়। সরকারি নীতি ও কার্যাবলি সরকারি কর্মচারীদের দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হয় বটে, তবুও তাদের দল ও রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে হয়।
.১৩. আর্থিক সুবিধা : আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের কর্মচারীবৃন্দ আর্থিক সুবিধা লাভ করে থাকেন। কর্মচারীদেরকে বেতন স্কেলের পদক্রমের বিভিন্ন পদ অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস করা হয়।
১৪. নিয়মানুবর্তিতা : কঠোর নিয়মানুবর্তিতা এবং জনকল্যাণ সাধনের আদর্শও আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হয়। নির্ধারিত নিয়মশৃঙ্খলার প্রতি গভীর আনুগত্যের ভিত্তিতে বিবিধ প্রশাসনিক কার্যসম্পাদনের মাধ্যমে সর্বসাধারণের সর্বাধিক কল্যাণসাধনের কার্যে আমলাগণ আত্মনিয়োগ করেন।
১৫. প্রধান জীবিকা : আমলাতান্ত্রিক সংগঠনে অফিসকে কর্মচারীদের প্রধান জীবিকানির্বাহের উপায় বলে মনে করা
হয়। অর্থাৎ এখানে সংগঠনের কর্মচারীরা অফিসকে তাদের প্রধান জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করে নেয়।
১৬. পদোন্নতি ; আমলাতান্ত্রিক সংগঠনে কর্মচারীদের টেকনিক্যাল জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের উপর জোর দেওয়া হয়। এখানে পারদর্শিতা বা সিনিয়রিটি বা উভয় মানদণ্ড অনুযায়ী কর্মচারীদের পদোন্নতি দেয়া হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, আমলাতন্ত্রের সঠিক ধারণার জন্য এর বৈশিষ্ট্যগুলো খুবই প্রয়োজনীয়। শুধু সরকারি অফিসেই নয়, বিভিন্ন সংগঠন এবং সংস্থায় এ বৈশিষ্ট্যগুলো পরিলক্ষিত হয়। অনেকে আমলাতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তা সত্ত্বেও এটা বলা যায় যে, আমলাতন্ত্রকে বাদ দিয়ে কোনো শাসনব্যবস্থা চলতে পারে না। সুতরাং বলা যায় যে, আধুনিক কালে আমলাতন্ত্র একটি প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান। তবে কার্যকরী পদ্ধতি অবলম্বন করে এর দোষত্রুটিগুলো অনেকটা লাঘব করা যেতে পারে।