বাংলাদেশের সংবিধানের উল্লেখযোগ্য সংশোধনীসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর পটভূমি ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর খাঁটি রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের আবির্ভাব হয়। যুদ্ধবিধস্ত দেশের একদিকে স্বীকৃতি অন্যদিকে সংবিধান প্রণয়ন ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দীর্ঘ আলোচনার পর ওয়েস্ট মিনিস্টার টাইপের একটি সংবিধান ১৯৭২ এর ১৪ ডিসেম্বর গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর হতে তা কার্যকর করা হয়। কিন্তু অতিদ্রুত দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের প্রয়োজনে এ সংবিধানের সংশোধনী শুরু হয়। এ পর্যন্ত ষোলোটি সংশোধনী গ্রহণ করা হয়েছে। যার মধ্যে চতুর্থ সংশোধনীটি ছিল অন্যতম আলোচিত।
চতুর্থ সংশোধনীর প্রেক্ষাপট : আওয়ামী লীগের জন্য ১৯৭৪ সাল ছিল সবচেয়ে দুর্যোগ ও সংকটপূর্ণ সময়। অর্থনীতির সব পর্যায়ে অব্যাহত অব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের ব্যাপক বিস্তৃতি, সর্বোপরি, দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা সবই ক্ষমতাসীন সরকারকে দিশেহারা করে দিয়েছিল। নিম্নলিখিত পরিস্থিতির কারণে চতুর্থ সংশোধনীর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এ কারণগুলো হলো :
১. ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া বিদ্যমান আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন পদ্ধতি। সবসময়ই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রশাসনে সংস্কারমুখী পরিবর্তন সাধনের পক্ষপাতী ছিলেন।
২. ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা যা ইতোমধ্যেই সংসদের ৪জন আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিসহ দলের অসংখ্য নেতাকর্মীর প্রাণহানির কারণ হয়েছিল। গুপ্তহত্যা, অর্থনীতির ব্যাপক ধ্বংস সাধন, ধ্বংসমূলক তৎপরতা ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে দালালদের কথিত ভূমিকা।
৪. জাসদসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গুপ্তবিপ্লবী সংগঠনগুলোর ভূমিকা এবং তাদের বিধ্বংসী তৎপরতা।
৫. গোষ্ঠী বিশেষের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রের উপস্থিতি।
৬. দুর্যোগময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দেশে দুর্ভিক্ষে মরণাঘাত, খাদ্যাভাব এবং বৈদেশিক সাহায্যের উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা।
৭. প্রশাসন, শিল্প এবং শিক্ষাব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলা।
৮. বিদ্যমান বিচারব্যবস্থা ছিল উপনিবেশবাদী ধারার বাহক এবং জনগণের প্রয়োজন মিটানোর লক্ষ্যে তাতে সংস্কারমুখী পরিবর্তন ছিল অপরিহার্য। উপর্যুক্ত পরিস্থিতি সুস্পষ্ট স্বীকৃতি পাওয়া যায় যখন সংসদে চতুর্থ সংশোধনী গৃহীত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন “প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার কায়েমের মধ্য দিয়ে দেশে দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা করা হয়।” এর অর্থ দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা, দুর্নীতিবাজ ঘুসখোর ও চোরাকারবারিদের উৎখাত করা। সংশোধনী সম্পর্কে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ বলেছেন, “বাংলাদেশে বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের অবসান ঘটেছে ও জনগণের সাচ্চা গণতন্ত্র তথা শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে এবং নতুন জাতীয় ঐক্য কায়েমের ব্যবস্থাও গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ চতুর্থ সংশোধনীর প্রয়োজনীয়তা ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
উদ্দেশ্য : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন না করলে পরিস্থিতি কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব হবে না। এজন্য প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই ছিল সব সমস্যার মূল সূতিকাগার এবং কেবলমাত্র একটি নতুন ধরনের প্রশাসন প্রক্রিয়ার উদ্ভব ঘটিয়েই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তাঁর ধারণা ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়ে একটি কর্তৃত্বমুখী প্রশাসন কাঠামো গড ়ে তুলতে পারলেই অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও ক্রমাবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তোলা যাবে। এ কাজের জন্য সরকারের হাতে হস্তক্ষেপবিহীন অতিরিক্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করা ছিল অপরিহার্য। যার কারণে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রয়োজন হয়। এ সংশোধনীর মূল উদ্দেশ্য ছিল নিম্নরূপ :
চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সরকারের উপর তার রাজনৈতিক দলের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যাতে করে তা,
১. সরকার ও রাজনৈতিক দলকে সমন্বিত করতে সক্ষম হয়।
২. সশস্ত্রবাহিনী; বিচার বিভাগ ও জাতীয় সংসদসহ আমলাতান্ত্রিক সঠিক কাঠামোর সাথে রাজনৈতিক দলের সমন্বয়সাধন করতে পারে।
৩. সকল বিক্ষিপ্ত জনশক্তিকে একক রাজনৈতিক দলের পতাকাতলে সমবেত করা। যাতে করে তারা অভিন্ন সত্য নিয়ে জাতি গঠনে অংশগ্রহণ করে সমাজের ভিতর থেকে দালাল, সশস্ত্র গেরিলা ও নতুন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রতিপক্ষদের নির্মূল করতে সক্ষম হয়।
৪. এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করে যেখানে জনপ্রতিনিধিরা একই দলের মনোনীত তিন চার প্রার্থীর মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয় তাকে দমন করতে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করতে চতুর্থ সংশোধনী গৃহীত হয়।