অথবা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা ব্যক্তিগত বা বেসরকারি খাত হতে সরকারি খাতে আনয়ন করাকে শিল্পের জাতীয়করণ বা রাষ্ট্রীয়করণ বলা হয়। রাষ্ট্রীয়করণের ফলে শিল্পকারখানার উপর ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটে এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয়করণকৃত বা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহ ব্যক্তিগত স্বার্থের পরিবর্তে জাতীয় স্বার্থে পরিচালিত হয়ে থাকে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশ সরকার দেশের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে জাতীয়করণনীতি ঘোষণা করেন। তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পরবর্তীকালে বিভিন্ন কারণে শিল্পের এ জাতীয়করণ ব্যবস্থার সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। সরকার বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতির আওতায় অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান পুনরায় বেসরকারি মালিকানায় হস্তান্তর করেছেন। অতএব, শিল্পের মালিকানা ও পরিচালনার ভার বেসরকারি মালিকের নিকট হতে সরকার কর্তৃক গ্রহণ করাকে শিল্পের জাতীয়করণ বলা হয়।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা : রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা মোটেও সন্তে ষিজনক নয়। রাষ্ট্রীয়করণের পর থেকেই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহ ক্রমাগত লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে অনেকেই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশ হয়েছেন এবং কেউ কেউ এগুলোকে ব্যক্তিগত মালিকানায় প্রত্যর্পণের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানা ক্রমাগত লোকসান দিয়ে প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। কিন্তু, এজন্য এককভাবে জাতীয়করণনীতিকে দায় করা যায় না। জাতীয়করণনীতির যথাযথ বাস্তবায়নের অভাব স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, কর্মচারীদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধের অভাবও অনেকাংশে দায়ী। এসব কারণে বর্তমানে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত
শিল্পকারখানাকে বেসরকারি মালিকানায় ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার মুক্ত বাজার অর্থনীতি চালু করেছেন। সরকার জাতীয়করণনীতি পরিহার করার কথা ঘোষণা করেছেন। ইতোমধ্যে সরকার বিরাষ্ট্রীয়করণনীতির অধীনে দেশের অধিকাংশ শিল্পকারখানা ব্যক্তিগত মালিকানায় ফেরত দিয়েছেন। এরূপ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল নয়। বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ব্যবস্থাপনা সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে কিছু কিছু কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সরকারের উদ্দেশ্য হলো সরকারি খাতকে সুসংবদ্ধ করে দক্ষভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলোর পরিচালনার ব্যবস্থাপনা করা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে সুযোগ প্রদান করা। সরকারি খাতের শিল্পগুলোতে বাজারজাতকরণ, আর্থিক শৃঙ্খলা ও মূল্য নিরূপণ পদ্ধতির উন্নতি বিধানের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ক্রয় ও সংগ্রহ, প্রকল্প বাস্তবায়ন, বাজারজাতকরণ ও মূল্যনির্ধারণের ক্ষেত্রে এবং আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অভিন্ন নীতি প্রবর্তনের জন্য কর্পোরেশনগুলোকে অধিকতর ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে কিছু কিছু শিল্প ইতোমধ্যেই বাণিজ্যিক দিক থেকে দক্ষ ও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার বিরাষ্ট্রীয়করণনীতি গ্রহণ করলেও এখনো সরকারি খাতের অধীনে বহু শিল্পকারখানা পরিচালিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে কিছু কিছু রাষ্
ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে শিল্পের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বাজারজাতকরণ, আর্থিক শৃঙ্খলা ও মূল্য নিরূপণ পদ্ধতির উন্নতির জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ক্রয়, সংগ্রহ, বিক্রয়মূল্য প্রভৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ইউনিটগুলোতে বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে হিসাব সংরক্ষণ প্রথা চালু করা হয়েছে। বর্তমানে পাট শিল্প সংস্থা, বস্ত্র শিল্প সংস্থা, চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থা, বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থা লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ বস্ত্র শিল্প সংস্থা ১৯৮২-৮৩ সালে ১০.১২ কোটি টাকা এবং ১৯৮৩-৮৪ সালে ১৭.৫০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করে। বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থা ১৯৭৯-৮০ সালে ৮ কোটি ৩৫ লক্ষ টাকা ১০-৮১ সালের ১১ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা মুনাফা অর্জন করে। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থা ১৯৮২-৮৩ সালে ৪৩ কোটি ৩৩ লক্ষ টাকা এবং ১৯৮৩-৮৪ সালে ৩৮ কোটি ৭৯ লক্ষ টাকা মুনাফা অর্জন করে। বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থা ১৯৮২-৮৩ সালে ৩৬ কোটি ৫ লক্ষ টাকা মুনাফা এবং ১৯৮৩-৮৪ সালে ২৬ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা মুনাফা অর্জন করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব ভীত হওয়ার কোন কারণ নেই। সরকার যদি আন্তরিকতা ও দক্ষতার সাথে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানা পরিচালনা করে তাহলে আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানাসমূহ লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে এবং দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হলো সরকারি খাতকে সুদৃঢ় করে দক্ষতার সাথে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিচালনা করা এবং পাশাপাশি বেসরকারিখাতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে অধিক উৎসাহ প্রদান করা।