বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের সমস্যাবলি আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের সমস্যাবলির প্রধান কারণগুলো বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের সমস্যাবলি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের সমস্যাবলির কারণসমূহ আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা
শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা ব্যক্তিগত বা বেসরকারি খাত হতে সরকারি খাতে আনয়ন করাকে শিল্পের জাতীয়করণ বা রাষ্ট্রীয়করণ বলা হয়। রাষ্ট্রীয়করণের ফলে শিল্পকারখানার উপর ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটে এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। হুকুমদখল বা উপযুক্ত মূল্য প্রদানের মাধ্যমে সরকার ব্যক্তিগত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা গ্রহণ করেন এবং এসব রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। জাতীয়করণকৃত বা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহ ব্যক্তিগত স্বার্থের পরিবর্তে জাতীয় স্বার্থে পরিচালিত হয়ে থাকে। শিল্পের মালিকানা ও পরিচালনার ভার বেসরকারি মালিকের নিকট হতে সরকার কর্তৃক গ্রহণ করাকে শিল্পের জাতীয়করণ বলা হয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের সমস্যাবলি : বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের সমস্যাবলির প্রধান কারণগুলো নিম্নরূপ :
১. অত্যধিক জনবল : রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় অত্যধিক জনবল। দেখা গেছে যে, প্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রমিকের সংখ্যা বেশি না হলেও দপ্তরের কর্মচারী ও কর্মকর্তার সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত। কিন্তু, এসব অতিরিক্ত জনবলের প্রান্তিক উৎপাদন শূন্য। এদের বেতন ও ভাতাদি বাবদ খরচ মিলগুলোর জন্য সম্পূর্ণ অপচয়। ফলে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের লাভের গুড় পিঁপড়ায় খেয়ে ফেলে। শিল্পোন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। করছে। ফলে আধুনিক প্রযুক্তিতে উৎপাদিত পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় সরকারি প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারছে না। ফলে
২. উন্নত প্রযুক্তির অভাব : অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পুরাতন যন্ত্রপাতি ও মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তি দিয়ে কাজ।
৩. সুদক্ষ সংগঠকের অভাব : জাতীয়করণের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহ প্রথম যে অসুবিধার সম্মুখীন হয় | তা হলো সুদক্ষ সংগঠকের অভাব। স্বাধীনতাত্তোর পর্যায়ে বাংলাদেশের সব পাটকল, কাপড়ের কল ও চিনিকলসহ দেশের মূল শিল্পসমূহ রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। কিন্তু, এ বিরাট জাতীয়করণকৃত খাত সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য যে ধরনের
সংগঠকের প্রয়োজন তা আমাদের দেশে গড়ে উঠেনি। ফলে বাংলাদেশে শিল্পোন্নয়ন ব্যাহত হয় ।
৪. আপেক্ষিক সুবিধাবিহীন শিল্প : সরকারি উদ্যোগে স্থাপিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান সাধারণত লাভক্ষতির কঠোর নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা হয় না। বিগত দিনে আমদানি বিকল্প শিল্পায়ন কৌশল অনুসরণ করে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে। যেগুলোর আপেক্ষিক সুবিধা নেই। ফলে এগুলো বাজারে নিয়মিত ক্ষতি দিতে বাধ্য হচ্ছে।
৫. শ্রমিক অসন্তোষ : বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের পরিচালনা ও ব্যবস্থার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে কোনোরূপ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এর ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে শ্রমিকদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত না হওয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং শ্রমিক আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। ফলে শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়।
৬. স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি : স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, উৎকোচ গ্রহণ ইত্যাদি বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের বড় সমস্যা। আমাদের দেশে প্রচলিত নিয়মনীতি উপেক্ষা করে চাকরিতে নিয়োগ, পদোন্নতি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি অর্থ আত্মসাতের প্রবণতাও বৃদ ্ধি পায়। এর ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের বাণিজ্যিক সাফল্য ব্যাহত হয়।
৯. উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি : রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহে উৎপাদন ব্যয় যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ও কাঁচামালের অভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানাগুলোর পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহৃত হয় না। তাছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যয়সংকোচন নীতি অনুসরণ না করার দরুন উৎপাদন ব্যয় যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানা অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
১০. মূল্য নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশে অনেক সময় সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে।
এতে অনেক ক্ষেত্রে বাজারের প্রতিযোগিতামূলক মূল্যের তুলনায় কম দামে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে তার পণ্য বিক্রয় করতে হয়।
১১. লক্ষ্যমাত্রার অভাব : রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহে উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ছিল না। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রয়োজনীয় সমন্বয় ছিল না। এ কারণে অনেক সময় অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ে পুরাপুরি সফলতা লাভে ব্যর্থ হয়।
১২. শক্তিসম্পদের স্বল্পতা : প্রয়োজনীয় শক্তিসম্পদের অভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ অসুবিধার সম্মুখীন হতো। বিশেষ করে অনিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহের কারণে শিল্পোৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
১৩. সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব : বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের অন্যতম সমস্যা হলো সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে নিয়োজিত বিভিন্ন কর্মচারী ও শ্রমিকদের মধ্যে এ ধরনের সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেনি। সমাজতান্ত্রিক মনোভাবের অভাবে বিভিন্ন কর্মচারী ও শ্রমিকদের মধ্যে দুর্নীতি ও কর্মবিমুখতা দেখা দেয়। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
১৪. জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট শিল্প : সরকারি খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠান অনেক সময় লাভলোকসানের ভিত্তিতে না হয়ে জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে এসব শিল্পের অনেক ক্ষেত্রে তুলনামূলক সুবিধা না থাকায় লোকসানের সম্মুখীন হয়।
১৫. সমন্বয়ের অভাব : বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব হলো রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের অন্যতম সমস্যা। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে মন্ত্রণালয়ের শিল্প বিভাগ, সেক্টর কর্পোরেশন এবং শিল্প ইউনিটগুলোর কাজের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়। প্রায়ই দেখা যায় যে, বিভিন্ন বিভাগ তাদের নিজ নিজ খেয়ালখুশি মতো কাজ করে। বিভিন্ন বিভাগের কাজের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন ব্যাহত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহ নানারকম সমস্যাবলির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এর জন্য দায়ী। যথাযথ সমর্থন বা পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এসব সমস্যাসমূহ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব ।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6%e0%a7%87/