বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যগুলোর বর্ণনা দাও।
অথবা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পর্যালোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকাঃ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দল ব্যবস্থার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কেননা, এ দেশে বর্তমানে সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। তাছাড়া অতীতে এখানকার রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করে তাদেরকে স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে। স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলে তাদের পতন ঘটায়। বর্তমানেও বাংলাদেশের দলগুলো সরকার বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার। জনগণের দাবিদাওয়া পূরণেও রাজনৈতিক দলগুলো সদা সচেষ্ট রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য : নিম্নে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. বহুদলীয় ব্যবস্থা : বাংলাদেশে বহুদলীয় রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা বিদ্যমান এ দেশে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৮০টির মতো রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
২. বাম, ডান ও মধ্যপন্থি দল : বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রধানত বাম, ডান ও মধ্যপন্থি এ তিন ভাগে বিভক্ত। দলগুলোর এ বিভক্তি থেকে এদের আদর্শগত প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। বামপন্থি দলগুলো দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। পক্ষান্তরে, ডানপন্থি দলগুলো মূলত ধর্মভিত্তিক এবং দেশে ইসলামি শাসনব্যবস্থা
কায়েমে বদ্ধপরিকর। অপরদিকে, এমন কিছু দল রয়েছে যেগুলো এ দু গ্রুপের মাঝামাঝি অবস্থান করে। তারা সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সংমিশ্রমে এক ধরনের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতি।
৩. সীমিত সাংগঠনিক কাঠামো : বাংলাদেশের অসংখ্য দলগুলোর মধ্যে মাত্র দুই তিনটি দলের সারাদেশব্যাপী সংগঠন রয়েছে। বাংলাদেশে ১৮০টি দলের মধ্যে মাত্র বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর দেশব্যাপী সংগঠন রয়েছে।
৪. অসংগঠিত দলব্যবস্থা : বাংলাদেশের দল ব্যবস্থা খুবই অসংগঠিত। এ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই সুসংগঠিত নয়। খুব কমসংখ্যক দলেরই সমগ্র দেশব্যাপী সংগঠন রয়েছে। কয়েকটি দল যেমন- আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছাড়া অন্যান্য সব দলই অত্যন্ত অসংগঠিত।
৫. একাত্মতার সংকট : বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে একাত্মতার সংকট প্রকট। তারা অধিকাংশ সময়ই ঐকমত্যে পৌছাতে পারে না। এরা গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে নিন্দাবাদী হয়ে ওঠে।
৬. আদর্শগত দিক : আদর্শগত দিক থেকে বাংলাদেশের দল ব্যবস্থায় বামপন্থি ও ডানপন্থি মতাদর্শের সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়। ডানপন্থি দলগুলো ব্যক্তিমালিকানায় বিশ্বাসী এবং এদের মধ্যে বেশিরভাগই ধর্মভিত্তিক। বাংলাদেশের প্রধান দুটি দলের মধ্যে অবশ্য আদর্শগত কোনো পার্থক্য দেখা যায় না।
৭. অভ্যন্তরীণ দলীয় মতানৈক্য ও কোন্দল : বাংলাদেশে এমন একটি দল খুঁজে পাওয়া যাবে না যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ দলীয় মতানৈক্য ও কোন্দল পরিদৃষ্ট হয় না। এর জন্য অবশ্য নানাবিধ কারণ দায়ী। তবে আদর্শগত ও মনস্তাত্ত্বিক কারণই এক্ষেত্রে প্রাধান্য লাভ করে। এর ফলে দলগুলোর মধ্যে ভাঙন দেখা দেয় এবং নতুন নতুন দলের উদ্ভব হয়।
৮. বিদেশি শক্তির প্রভাব : বাংলাদেশের সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক অবস্থা অনেকাংশে বৃহৎ শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়। এ দেশের অনেক রাজনৈতিক দলই বৈদেশিক শক্তির নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত হয়। বিদেশি শক্তির লেজুড়বৃত্তি করা বাংলাদেশের দলীয় ব্যবস্থার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৯. ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলের অস্তিত্ব : বাংলাদেশে অনেক দলের উদ্ভব ঘটেছে কিছুসংখ্যক ব ্যক্তিত্বের কারণে। এখানে জনগণের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত নেতৃবৃন্দই ক্রমে দল গঠন করেন এবং উক্ত নেতৃবৃন্দের সমর্থনই দলের সমর্থনে পরিণত হয়। উক্ত নেতা বা নেতৃবৃন্দের মৃত্যু বা অপসারণ ঘটলে সে বিশেষ দল বা দলগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়।
১০. অঙ্গদলের অস্তিত্ব : বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গদল রয়েছে। ছাত্র ফ্রন্ট, যুব ফ্রন্ট, কৃষক ফ্রন্ট, শ্রমিক ফ্রন্ট— এগুলো হচ্ছে প্রধান অঙ্গদল । এ ফ্রন্টগুলো রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। দলীয় কর্মসূচি ও কর্মকাণ্ডে তাঁরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্বভাবতই রাজনীতি ক্ষেত্রে এসব ফ্রন্টের তথা অঙ্গ সংগঠনের
প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। শুধু আওয়ামী লীগই নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রেও এটা সমভাবে প্রযোজ্য।
১১. বিরোধী ও সরকারি দলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব : বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে মতানৈক্য ও দ্বন্দ্ব বিরোধ লেগেই থাকে। এটা এখানকার দল ব্যবস্থার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। এখানে যে দল সরকার গঠন করে সে দলের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো খুব তৎপর থাকে। সমালোচনা গঠনমূলক হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বাংলাদেশে সর্বদা এর বিপরীত অবস্থাটি দৃষ্ট হয়। ফলে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতি লেগেই থাকে।
১২. নিম্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতি : প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দলই এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠেনি। গণতন্ত্র সম্পর্কে বাংলাদেশের সরকারি ও বিরোধী দলের ধারণা Contradictory. বাংলাদেশের নেতানেত্রীরা যখন কথা বলেন তখন চরম সীমায় অবস্থান করেন। এর ফলে রাজনীতির মান নেমে গিয়ে পৌঁছেছে। নিম্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে।
১৩. দল সংগঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রাধান্য : এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার অপর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। দল সংগঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রাধান্য আমাদের দলীয় ব্যবস্থার একটি অতি সাম্প্রতিক প্রবণতা।
১৪. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : বাংলাদেশের সরকারি এবং বিরোধী দলের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি চর্চার ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের দলীয় ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে।
১৫. অঙ্গসংগঠন : অঙ্গ সংগঠনের অস্তিত্ব বাংলাদেশের দল ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এখানে প্রায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলেরই বিভিন্ন নামে অঙ্গ সংগঠন রয়েছে। দলীয় সমর্থন ও প্রভাব বৃদ্ধি করা এবং দলীয় কর্মসূচির প্রচার ও বাস্তবায়নে সহায়তা করা এ অঙ্গ সংগঠনগুলোর প্রধান দায়িত্ব। এ অঙ্গ সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। বস্তুত তাদের কর্মকাণ্ডের উপরই দলের সার্বিক সফলতা অনেকাংশে নির্ভরশীল ।
উপসংহার : পরিষেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের দল ব্যবস্থায় উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ এদেশের দলীয় পদ্ধতিকে এক বিশেষ স্বকীয়তা দান করেছে এবং এক বিশেষ খাতে প্রবাহিত করেছে। বিশ্বের উন্নত রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলোতে দল ব্যবস্থার যেসব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় বাংলাদেশের দলীয় ব্যবস্থায় সেগুলো অনেকাংশে অনুপস্থিত। ফলে এখানকার দলগুলো মূলত অসংগঠিত দুর্বল ও অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।