অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনের বৈরী ভূমিকা বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনের ভূমিকা ছিল নেতিবাচক। কৌশলগত অবস্থান ও রাজনৈতিক স্বার্থে চীন মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেন। পাকিস্তানে সংঘটিত ঘটনাকে তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে চীন সরকার উল্লেখ করে এবং তাদের দু’অংশকে ঐক্যে পৌঁছানোর আহ্বান জানায়। চীন সরকার আওয়ামী লীগ কর্তৃক গৃহীত
যেকোনো পদক্ষেপের মধ্যে ভারতের গন্ধ খুজতে ব্যস্ত থাকত। চীন সরকারের নীতিতে স্বাধীনতাকামী বাঙালির মনে গভীর হতাশার সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনের ভূমিকা : চীন সরকার শুরু থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ভিত্তিতে বাংলাদেশের বিষয়ে তার নীতিনির্ধারণ করে। নিচে মুক্তিযুদ্ধে চীনের ভূমিকা ব্যাখ্যা করা হলো :
১. চীনের পাকিস্তানপন্থি নীতি গ্রহণ : মুক্তিযুদ্ধে চীন বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে চীন তেমন কোনো মন্তব্য করেনি। কিন্তু গোপনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক চক্রকে নৈতিক শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিল এবং সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে সামরিক উপকরণ সরবরাহ করেছিল। ১১ এপ্রিল ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি চৌ এন লাই চিঠিতে জানায় যে, পাকিস্তানের ঘটনাবলিকে সে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে জানান এবং জনগণ বিদেশি হস্তক্ষেপ ছাড়াই তা সমাধান করবে বলে উল্লেখ করেন। এমনকি পাকিস্তানের ‘জাতীয় স্বাধীনতা’ ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় চীনের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কথাও তিনি জানিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চীন বাঙালির সংগ্রাম ও নির্যাতনের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখায়নি।
২. পাকিস্তানকে অস্ত্র সহায়তা : ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট ভারত সোভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরের পর চীন পাকিস্তান নীতি আরো প্রকট হয়ে উঠে। সেপ্টেম্বর মাসে চীন পাকিস্তানকে জানায় যে, জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় চীন পাকিস্তানকে সাহায্য করবে। পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে চীন নিয়মিতভাবে পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র পাঠাতো। এছাড়া গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণ দানের জন্য চীন অক্টোবর মাসে ঢাকায় ২০০ সামরিক বিশেষজ্ঞ পাঠিয়ে ছিল। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী যে সকল অস্ত্র ব্যবহার করে তার ৬০% ছিল চৈনিক।
৩. পাকিস্তান ছিল চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র : পাকিস্তানের সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব বিদ্যমান। চীন সরকার বন্ধুত্বের সম্পর্ক জোরদার ও অক্ষুণ্ন রাখতে পাকিস্তানকে সমর্থন করে। ফলে পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে বন্ধুত্ব সুঢ়ঢ় হয় এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতি চীনের আস্থা বৃদ্ধি পায়।
৪. কূটনৈতিক তৎপরতা : আগস্ট মাসে ভারত সোভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষর হলে চীন নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ফলে চীন সরকার পাকিস্তানকে সমর্থন করে জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষায় ন্যায়সংগত সংগ্রামে পাকিস্তানকে সমর্থন করে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য জাতিসংঘে তৎপরতা চালায়।
৫. চীনের জাতিগত সমস্যা : চীন একটি বহুজাতিক দেশ, চীনা, মঙ্গোল, তিব্বতি, তুর্কি ইত্যাদি জনগোষ্ঠী নিয়ে গড়ে উঠেছে চীনের রাষ্ট্রীয় সত্তা। একাধিক জাতি অধ্যুষিত পার্শ্ববর্তী কোনো দেশ সংগ্রামরত কোনো জনগোষ্ঠীকে সমর্থন ভবিষ্যতে তা অভ্যন্তরীণ সংহতির প্রতি হুমকি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ফলে চীন জাতিগত সমস্যাকে অভ্যন্তরীণ
সমস্যা বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে।
৬. সোভিয়েত প্রভাব মোকাবিলা : চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় দেশ সমাজতান্ত্রিক হলেও চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাশিয়ার প্রভাব হ
্রাসে এবং মোকাবিলার জন্য পাকিস্তানকে সমর্থন প্রদান করে।
৭. জাতিসংঘে বাংলাদেশ বিরোধিতা : ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের পূর্বাঞ্চলে সামরিক হামলা করলে শুরু হয় সরাসরি পাক ভারত যুদ্ধ। যৌথবাহিনী ৪ ডিসেম্বর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনীর বর্বরতার ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করার লক্ষে ৫ ও ৭ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে দুটি প্রস্তাব উপস্থাপন করে। কিন্তু প্রস্তাব দুটির বিরুদ্ধে চীন ভেটো প্রয়োগ করেছিল। এছাড়া চীনের নিজস্ব প্রস্তাবে ভারতকে আগ্রাসী পক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, চীন মুক্তিযুদ্ধে আগাগোড়া অত্যন্ত কৌশলী ভূমিকা নেয়। পাক ভারত যুদ্ধের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে দায়ী করে চীন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে চীন এক বিবৃতিতে তথাকথিত বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ওভারতের তীব্র সমালোচনা করে। স্বাধীন বাংলাদেশকে তথাকথিত বাংলাদেশ
বলে অভিহিত করা বাঙালির স্বাধীন অস্তিত্বের প্রতি ছিল চরম ঘৃণা ও অবহেলার শামিল। এমনকি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চীন বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। কাজেই মুক্তিযুদ্ধে চীনের ভূমিকা ছিল বাংলাদেশ বিরোধী।