অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের’ ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে বাঙালি মুসলমানদের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। পাকিস্তান সৃষ্টির পর আশা করা হয়েছিল যে, উভয় অংশের জনগণ জীবনের সর্বস্তরে ভ্রাতৃসুলভ সৌহার্দ্য নিয়ে মিলেমিশে বসবাস করবে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী স্বাধীনতার পরবর্তীকালে আর্থসামাজিক,
রাজনৈতিক প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে বাঙালি জাতির উপর শোষণ ও নির্যাতন শুরু করে। এ শোষণ নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলার জনগণ ১৯৭১ সালে এক সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।
১. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট : নিচে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হলো :
ক. বাঙালিদের উপর শোষণ ও নির্যাতন : ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর নির্ভর করে ভারত বিভক্ত হয় এবং জন্ম হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে দমন করে রাখার অপকৌশল গ্রহণ করে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সর্বক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের শোষণ করতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ইচ্ছা পূর্ব পাকিস্তানের উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে থাকে। মূলত পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত করে। যার থেকে মুক্তি পাবার জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
খ. জনগণের রায় উপেক্ষা : ১৯৬৯ সালে স্বৈরাচারী আইয়ুন খান ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয় এবং তার স্থলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন ইয়াহিয়া খান। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি ঘোষণা দেন ১৯৭০ সালে নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে কিন্তু আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করলে পাকিস্তানের সামরিক সরকার আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিভিন্ন টালবাহানা শুরু করে। জনগণের রায়কে উপেক্ষা করে গণরায়কে বানচাল করার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র শুরু করে।
গ. ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। বঙ্গবন্ধু বৈধ ক্ষমতার অধিকারী হয়। কিন্তু সামরিক সরকার আওয়ামী লীগের এ বিজয়ে বিচলিত ও ভীত হয়ে পড়ে। তারা আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি ছিল না। সামরিক সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতা
হস্তান্তরে অনীহা প্রকাশ করে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করেন। ফলে পিপিপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চরমে উঠে, যার ফলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
ঘ. ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র ও ক্ষমতা লিপ্সা : পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ‘৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বৈধ দাবিদার। কিন্তু ভুট্টো ও ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পক্ষপাতী ছিল না। তারা নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু করে ভুট্টো আওয়ামী লীগকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করতে চায়। ইয়াহিয়া খান ও পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগকে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা প্রদানে ইচ্ছুক ছিল না। ফলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় । ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করেন। এরূপ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
২. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা পরিক্রমা : নিচে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা পরিক্রমা তুলে ধরা হলো :
ক. ৭ মার্চ এর ভাষণ :
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ভাষণ প্রদান করেন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে বিপুলসংখ্যক জনতা স্বাধীনতার দাবিতে একত্রিত হয়। বঙ্গবন্ধু এ ভাষণে জনতাকে মুক্তিসংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে বলেন। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি।
খ. ২৫ মার্চ এর গণহত্যা : দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পরেও রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয় পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খান। জুলফিকার আলী ভুট্টো ছয় দফাকে মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে থাকে অটল। ফলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বৈধ ক্ষমতার অধিকারী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা প্রদান না করে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা সহ সারাদেশে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির উপর নৃশংস গণহত্যা শুরু করে। অপারেশন সার্চলাইট নামে সামরিক অভিযানে হাজার হাজার বাঙালি হত্যা করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পরিস্থিতি উপলব্ধি করে গ্রেপ্তারের পূর্বমুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
৩. মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিরোধ আন্দোলন : পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, লুণ্ঠন ও নারীনির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালিরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রতিরোধ তীব্র হলে পাকবাহিনী সমগ্র দেশে বিভীষিকা সৃষ্টি করে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। সর্বস্তরের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে নিয়মিত বাহিনী সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ছাত্র, তরুণ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কৃষক ও শ্রমিকদের নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করে মুক্তিবাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । বিদ্রোহী সশস্ত্রবাহিনীরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলে প্রতিরোধ আরো শক্তিশালী হয়। গেরিলা বাহিনী বিক্ষিপ্তভাবে ও চোরাগুপ্তা হামলা করে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়। ক্রমান্বয়ে পাকিস্ত পানি বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের জনসমর্থনহীন এ বাহিনী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ও তৎপরতার ফলে দিশেহারা হয়ে পড়ে। ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করলে যুদ্ধের গতি তীব্র হতে থাকে। অবশেষে ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর কাছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল পৌনে ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার সেনা সদস্যসহ লেঃ জেঃ নিয়াজী কাছে আত্মসমর্পণ করে। শেষ হয় দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়।
৪. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল : দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে অর্জিত হয় কাঙ্ক্ষিত বিজয়। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ ও জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে আসছিল তার বাস্তবায়ন ঘটে ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতার জন্য বাঙালিরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য। ৩০ লক্ষ শহিদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয় আজকের এ সার্বভৌম বাংলাদেশ। প্রাণ দিতে হয়েছে অসংখ্য শিক্ষক, ছাত্র, সাহিত্যিক, শিল্পী, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে। তবু বাঙালি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপস করেনি। স্বাধিকার আদায়ে সর্বদা জাগ্রত। পরাজিত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর তিরানব্বই হাজার সদস্য বাংলাদেশ ও ভারতের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, দীর্ঘ আন্দোলন আর ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ৩০ লক্ষ শহিদের রক্ত, বহু মা-বোনের সম্ভ্রম, আর দেশ বরেণ্য অসংখ্য বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যা এবং দেশের অ
বকাঠামোর এক ধ্বংসস্তুপের উপর উদিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লাল সূর্যটি। যেটা বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয়
ঘটিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের।