অথবা, বাংলাদেশের মহিলা আইনজীবী সমিতির কার্যাবলি বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের মহিলা আইনজীবী সমিতির কার্যাবলি সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশে বহু নারী সংগঠন কর্মরত। এরা নারীর মানবাধিকার রক্ষা সহ বহুবিধ কাজ করে। এরা নারীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি তার কর্মসংস্থানের জন্যও কাজ করে। তারা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধের জন্যও বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। সন্ত্রাসের শিকার নারীদের সাহায্য ও পুনর্বাসনের জন্যও কাজ করে। নারীদের দরিদ্রতা দূর করার জন্য তাদের বিভিন্ন প্রকল্পও আছে।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির কার্যাবলি : বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি বহুমুখী কার্য সম্পাদন করে। এসব কার্য নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. আইনগত সহায়তার মাধ্যমে মহিলাদের নিরাপত্তা বিধান করা : মহিলা আইনজীবী সমিতি বিভিন্ন সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের আইনগত সহায়তা প্রদান করে। সমিতি সারা দেশে ২৭টি আইন সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করেছে। সমিতির বিভাগীয় অফিস মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম সমন্বয় করে। তাছাড়া, সমিতির সদস্যগণ বিনা পারিশ্রমিকে সন্ত্রাসের শিকার নারীদের স্বেচ্ছায় আইনি সহায়তা দেয়।
২. সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের উদ্ধার ও মুক্তির ব্যবস্থা করা : বিভিন্ন সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের সমিতি উদ্ধার ও মুক্তির ব্যবস্থা করে। এই উদ্দেশ্যে তারা নিয়মিত থানা, জেলখানা ও কোর্ট পরিদর্শন করে। প্রয়োজনে তারা নারী ও শিশুদের উদ্ধারের জন্য আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
৩. সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা : মহিলা আইনজীবী সমিতি সহিংসতার শিকার ও পাচারকৃত নারীদের উদ্ধার ও মুক্তির ব্যবস্থা করে। এরপর তাদের যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। এজন্য সমিতির পুনর্বাসন কেন্দ্র বা আশ্রয় হোম আছে।
৪. পাচারকৃত নারী ও শিশুদের প্রত্যাবাসন করা : সমিতি বিদেশে পাচারকৃত নারী ও শিশুদের চিহ্নিত করে ফিরিয়ে আনার বা প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করে। এ ব্যাপারে তারা বিদেশি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। এ প্রসঙ্গে তারা সরকার ও দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থারও সাহায্য নেয়।
৫. আক্রান্তদের আইনি সহায়তার জন্য তথ্যানুসন্ধান : মহিলা সমিতি আক্রান্ত নারী ও শিশুদের রক্ষার জন্য তথ্যানুসন্ধান কাজও করে। কারণ সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত তথ্যের প্রয়োজন। কারণ পর্যাপ্ত তথ্য ব্যতীত অপরাধীকে চিহ্নিত করা যাবে না ও মামলা টিকবে না। এজন্য সমিতির একটি প্যানেল আছে। এর সদস্যগণ
হলেন আইনজীবী, সাংবাদিক, সমাজকর্মী ও সিভিল সোসাইটির সদস্য। এরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তদন্ত করে। এ কাজে সুবিধার জন্য তারা স্থানীয় প্রভাবশালীদের এ কাজে সম্পৃক্ত করে। এতে বিষয়টি মোকাবিলায় সুবিধা হয়।
৬. আশ্রয় হোম প্রতিষ্ঠা : মহিলা সমিতি নির্যাতিত নারী ও শিশুদের জন্য আশ্রয় হোম প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করে। ১৯৯৩ সাল হতে সমিতি এ কার্য পরিচালনা করে আসছে। এগুলো পরিচালিত হয় বিভিন্ন সংস্থার সাহায্যে। আশ্রয় হোমে নারী ও শিশুদের থাকার ব্যবস্থা করে, চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। এটা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইউনিটও পরিচালনা করে।
৭. সচেতনতা বৃদ্ধি : সমিতি নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি বন্ধ করার জন্য গণসচেতনতা সৃষ্টি করে। এজন্য সমিতি বিভিন্ন লোককে প্রশিক্ষণ দেয়। এসব লোক হলো সমিতির কর্মকর্তা, সীমান্ত বাহিনীর সদস্য, নিকাহ রেজিস্ট্রার, ইউপি মেম্বার প্রভৃতি। এসব প্রশিক্ষণের কোর্স হলো “Human Rights and Legal Awareness Training Course,
Human Rights and Persecution Course ইত্যাদি। প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরি করা হয়। এসব মডিউলের মাধ্যমে নারী ও শিশু পাচারের বিরুদ্ধে গণচেতনা সৃষ্টি করা হয়।
৮. মানব
াধিকার ও আইনের উপর প্রশিক্ষণ : মহিলা আইনজীবী সমিতি নারীর মানবাধিকার রক্ষার জন্যও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। সমিতি “Legal Awareness Education Implementation Committee.” গঠন করে সবাইকে মানবাধিকার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়। ফলে গণচেতনা সৃষ্টি হয়। এভাবে ফতোয়াঁ, হিল্লা বিয়ে ও বাল্য বিবাহের মতো কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গণচেতনা সৃষ্টি হয়।
৯. গ্রামীণ নাটকের উপর প্রশিক্ষণ : মহিলা আইনজীবী সমিতি নাটকের উপরও প্রশিক্ষণ দেয়। এসব নাটকের মাধ্যমে সমিতি সামাজিক অনাচার যেমন- বাল্য বিবাহ, সামাজিক অনাচার, বহু বিবাহ, যৌতুকের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করে । তাছাড়া, বিবাহ রেজিস্ট্রির সুবিধা, এসিড নিক্ষেপের শাস্তি, স্বামীর সম্পদে নারীর অধিকার সম্পর্কেও ধারণা দেয়। তাছাড়া, সমিতি নারী ও শিশু পাচারবোধেও প্রশিক্ষণ দেয়। এটা এইডস ও এইচ.আই.ভির উপরও প্রশিক্ষণও দেয়।
১০. এডভোকেসী, গবেষণা এবং অন্য শিক্ষা যোগাযোগ উপকরণ প্রকাশ : সমিতি নারীর জন্য এডভোকেসির কাজ করে। নারীর উপর সহিংসতার তথ্য সংগ্রহ করে গবেষণা করে। এসব গবেষণা সম্পর্কে প্রতিবেদনও প্রকাশ করে যা নারী নির্যাতন বন্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
১১. প্রকাশনার কাজ করা : মহিলা আইনজীবী সমিতি প্রকাশনারও কাজ করে। তারা পত্রিকা সম্পাদন করে, লিফলেট, পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশ করে। তাছাড়া, নারী ও শিশু অধিকার বিষয়ে মিডিয়ায় বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করে। এগুলো নারী ও শিশু অধিকার বিষয়ে মিডিয়ায় বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করে। এগুলো নারী ও শিশু অধিকার রক্ষায় সহায়ক হয়।
১২. টেলিফোন হটলাইট ব্যবহার করা : মহিলা আইনজীবী সমিতি সার্বক্ষণিক টেলিফোন ব্যবস্থা চালু রেখেছে। এটা করেছে গ্রামীণ ফোনের মাধ্যমে। এর উদ্দেশ্য হলো সমিতির কর্ণধারদের নিকট সার্বক্ষণিক ভাবে নারী নির্যাতনের সংঘটিত ঘটনা তাৎক্ষণিক ভাবে পৌছে দেয়া যাতে এর জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া যায়। সমিতি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করে।
১৩. নারী নির্যাতন বিষয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ : মহিলা আইনজীবী সমিতি নারীর বিরুদ্ধে সংগঠিত বিভিন্ন সহিংস ঘটনার বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসব প্রতিবেদন নারী নির্যাতনের সঠিক চিত্র প্রকাশ করে। ফলে এসব চিত্র ও পরিসংখ্যান দেশবাসীকে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে উদ্বুদ্ধ করে।
১৪. মহিলা সমিতি নারী নির্যাতন বন্ধে অন্যান্য কাজও করে। যেমন- সমিতি স্থানীয় ভাবে তথ্য সংগ্রহ করে, স্থানীয় পরিষদের সাথে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করে, মানব সম্পদ উন্নয়নে কাজ করে এবং নারী ও শিশু পাচাররোধে কাজ করে।
উপসংহার : মহিলা আইনজীবী সমিতি একটি মানবতাবাদী সংগঠন। এটি একটি মানবাধিকার সংগঠনও বটে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংগঠন ও সরকারের সহায়তায় এটি কাজ করে। বাংলাদেশে মানবাধিকার সংরক্ষণে এবং নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধে এর কার্যক্রম প্রসংশার দাবিদার।