বাংলাদেশের পোষক-পোষ্য সম্পর্কের ধরনগুলো আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের পোষক-পোষ্য সম্পর্কের ধরনসমূহ বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
আবহমানকাল থেকে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক চলে আসছে। গ্রাম-বাংলার প্রায় সকল মানুষই কোনো না কোনোভাবে পোষক-পোষ্য সম্পর্কে আবদ্ধ। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে প্রধানত ভূমির বণ্টন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পোষক-পোষ্য সম্পর্কের মূল কারণ হলো অর্থ।গ্রামীণ সমাজে পোষক-পোষ্য সম্পর্কের ভিত্তিতে একজন ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা নির্ভর করে। তাই বলা যায় যে, পোষক-পোষ্য সম্পর্ক হচ্ছে সামাজিক অবস্থান পদমর্যাদাগত পার্থক্যের সম্পর্ক।
পোষক-পোষ্য সম্পর্কের ধরন : রাষ্ট্রভেদে পোষক-পোষ্য সম্পর্কের ধরণ ভিন্ন হয়ে থাকে। শুধু রাষ্ট্রভেদে নয় একই রাষ্ট্রের সমাজভেদে পোষক-পোষ্য সম্পর্কের ধরনও ভিন্ন হয়ে থাকে। পোধক-পোষ্য সম্পর্ক তৈরি হয় সুনির্দিষ্ট কিছু শর্তের উপর ভিত্তি করে যে শর্তগুলি সমাজভেদে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন সমাজিক সম্পর্ক, প্রথা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন রকম। সমাজিক সম্পর্ক, সামাজিক প্রথা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নিম্নে পোষক-পোষ্য সম্পর্কের ধরন আলোচনা করা হলো।
১. ভূ-স্বামী ও ভূমিহীন পোষক-পোষ্য সম্পর্ক : বাংলাদেশের গ্রমীণ সমাজের পোষক-পোষ্য সম্পর্কের সবচেয়ে প্রচলিত ও সাধারণ ভিত্তি হলো ভূমি। ভূমির উপর ভিত্তি করে যে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেখানে দুই শ্রেণির অস্তি ত্ব লক্ষ্য করা যায়। একটি হচ্ছে ভূ-স্বামী শ্রেনী অন্যটি হচ্ছে ভূমিহীন শ্রেনী। পোষকের হাতে থাকে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ভূসম্পত্তি যা তারা নিজেরা চাষ করতে পারে না। তখন তারা পোষ্যদের যাদের কোনো জমি নেই তাদের এ জমি চাষ করার জন্য খাজনা অথবা বর্গা দিয়ে থাকে। তাদের চাষকৃত জমির ফসলের একটা বড় অংশ ভূমি মালিককে প্রদান
করতে হয় অথবা নির্ধারিত পরিমান অর্থ চাষের পূর্বে বা পরে পরিশোধ করতে হয়। এভাবে পোষ্য শ্রেণি জমি চাষ করে
জীবিকা নির্বাহ করে । ফলে প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে ভূ-স্বামীদের জমি পাওয়া নিয়ে সর্বদাই প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। সে জন্য প্রান্তিক কৃষকরা জমি চাষের সুযোগ লাভে ভূ-স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখতে সদা সচেষ্ট থাকে। এ সুযোগে মালিকগণ নিজের অনুকূলে নানাবিধ শর্তসাপেক্ষে পছন্দের লোককে জমি প্রদান করে থাকে। এভাবে চাষের জন্য জমি প্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে ভূ-স্বামী ও ভূমিহীনদের মধ্যে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
২. নির্বাচিত প্রতিনিধি ও জনগণ পোষক-পোষ্য সম্পর্ক : গ্রামীণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হলো ইউনিয়ন পরিষদ।ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধি। স্থানীয় সরকার সৃষ্টির লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামের সুবিধা বঞ্চিত, অবহেলিত, অসচেতন মানুষের জন্য সরকারের সেবা পৌঁছে দেওয়া। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজ হচ্ছে সাধারণ জনগণের পাশে অবস্থান করে সেবা প্রদান করা। ইউনিয়ন পরিষদে বিচার-সালিশ ও বিবাধ মিমাংসা করে থাকে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন পরিকল্পনাও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। এ সব উন্নয়নমূলক ও সেবামূলক কাজ-কর্ম করতে গিয়ে সাধারণ জনগণের সাথে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়।সাধারণ জনগণ এ সব কাজ-কর্ম থেকে সুবিধা প্রান্তির জন্য ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে সম্পর্ক রেখে চলে। সম্পর্ক অবশ্যই অসম। সম্পর্কের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই লাভবান হয়। এ অসম সম্পর্ককে পোষক-পোষ্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায় ।
৩. রাজনৈতিক নেতা ও জনগণ পোষক-পোষ্য সম্পর্ক : সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতি গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ফলে তৃর্ণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত রাজনীতির যোগসূত্রতা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড গ্রাম পর্যায় পরিচালিত হচ্ছে। রাজনীতি চর্চা হয় মূলত রাজতৈক দলকে কেন্দ্র করে। ফলে গ্রামের জনগণ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পদ ও পদবী গ্রহণ করছে। এ সব রাজনৈতিক নেতারা স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। সাধারণ জনগণের কথা প্রশাসন খুব একটা পাত্তা দেয় না। গ্রামের দরিদ্র, অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি, সরকারি অফিস-আদালতে যোগাযোগ ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য গ্রামের ঐ সব রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়। তখন সাধারণ জনগণের সাথে যে সম্পর্ক তৈরি হয় সেটি এক ধরনের নির্ভরশীল সম্পর্ক। পোষ্যদের এ নির্ভরশীলতার সুযোগে রাজনৈতিক পোষকরা তাদেরকে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করে।তাই এ নির্ভরশীল সম্পর্ককে আমরা পোষক-পোষ্য সম্পর্ক হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি ।
৪. প্রতিষ্ঠান-উন্নয়নকর্মী ও জনগণ পোষক-পোষ্য সম্পর্ক : বর্তমান বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও দেশি-বিদেশি এন.জি.ও কাজ করে যাচ্ছে। তারা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করছে। এ সব কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত হচ্ছেন গ্রামের তরুন শিক্ষিত, আধুনিক মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ । বর্তমানে গ্রামীণ অর্থনীতিরও ব্যাপক উন্নতি ও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তাদের কল্যাণে। ক্ষুদ্রঋণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, আধুনিক কৃষির উপকরণ, নিত্যনতুন উৎপাদন ধারণা, সৃষ্টিশীলতা দিয়ে স্বল্প শিক্ষিত ও অসচেতন গ্রামের জনগণ এখন বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা, পরামর্শ এ সকল প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বারস্ত হয়ে উপকৃত হচ্ছে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিবর্গের সাথে গ্রামের সাধারণ জনগণের সম্পর্ক তৈরি হয়। গ্রামের জনগণ বিপদে আপদে তাতের উপর ভরসা করে । তখন এ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিবর্গের সাথে সাধারণ জনগণের যে সম্পর্ক তাকে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক বলা যায়।
উপসংহার : আলোচনার পরিশেষে বলতে পারি যে, পোষক পোষ্য সম্পর্ক একটি সামাজিক শ্রেণির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই সম্পর্কের মাধ্যমে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে শোষণ বা কতৃত্বাধীনে রাখতে চায়। কিন্তু সমাজ দিনকে দিন উন্নত হচ্ছে এবং এই সম্পর্ক একেবারে নির্মূল না হয়ে নিত্য নতুন মাত্রায় আবির্ভূত হচ্ছে। সমাজে যারা শোষণের শিকার হয় অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণি এরা অতীতেও শোষিত হয়েছে, বর্তমানেও শোষিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও শোষিত হবে। এদের জীবনমান উন্নয়ন হচ্ছে না