বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিত্বকারী গ্রামের রূপরেখা তুলে ধর।

বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিত্বকারী গ্রামের রূপরেখা তুলে ধর।
অথবা, তুমি কি মনে কর কালের আবর্তনে গ্রামের গড়নে পরিবর্তন এসেছে? তোমার উত্তরের
সপক্ষে বিশ্লেষণ কর।
অথবা, বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিত্বকারী গ্রামের চিত্র বর্ণনা কর।
অথবা, গ্রাম বাংলার একটি স্বরূপ সবিস্তারে তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশে গ্রাম বলতে কখনো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ধরন (Dispersed) বা ঘন সন্নিবিষ্ট (Clustered) গৃহের সমষ্টিকে বুঝায়। তবে জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের গ্রাম অনেক বড়। সাধারণভাবে গ্রামের
জনসংখ্যা দশ হাজারের বেশি হতে পারে। প্রায় দৈনিক বাজার, হাট, স্কুল, মাদ্রাসার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুবিধা নিয়ে গ্রাম গড়ে উঠে। অন্যভাবে বলা যায়, নগরের বাইরে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে যে কৃষিক্ষেত্র আছে এবং সে কৃষির ভরণপোষণের জন্য যে কৃষিকর্মী আছেন, তাদের কৃষিক্ষেত্রের আশেপাশেই অবস্থান করতে হবে। কৃষিকর্মীদের অবস্থান ক্ষেত্রই হলো গ্রাম। বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিত্বকারী গ্রাম ( A representative village of Bangladesh) : বাংলাদেশ মূলত একটি গ্রাম এবং এ গ্রামেই বাংলাদেশের সিংহভাগ লোক বাস করে। রাতারাতি পরিবর্তিত হচ্ছে গ্রাম।
তবে ক্ষেত্রবিশেষে মূল কাঠামোটি এখনও অপরিবর্তিত। নিম্নে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিত্বকারী গ্রামের রূপরেখা তুলে
ধরা হলো :

১. বাস্তুস্থান (Site) : গ্রামে সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে বন্যামুক্ত স্থানে ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়। অন্যথায় পুকুর খনন করে জমি উঁচু করে সেখানে বসতি গড়ে তোলা হয়। গ্রামের অবস্থাপন্ন প্রায় প্রত্যেক পরিবারেই পুকুর রয়েছে। প্লাবন সমভূমির নিম্নাঞ্চলে পুকুর উল্লেখযোগ্য হারে খনন করা হয়েছে। তবে চাষের জমির অভাব, আর্থিক সঙ্গতি না থাকা, বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া বা মৎসচাষে সমস্যা প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের অনেক গ্রামেই পুকুর খনন না করে বাস্তুস্থান নির্বাচন করা হয়েছে।
২. গ্রামের সীমানা ও আকার (Boundary & size of the village) : গ্রামে স্থান সংকুলানের সমস্যা নেই। স্বভাবতই জনবসতিগুলো বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে উঠে। এখানে বহুতল বাড়িতে অল্প পরিসরের মধ্যে অধিকসংখ্যক পরিবারের গাদাগাদি বসবাসও নেই। তবে গ্রামের ঘরবাড়ি কখনো ঘনসন্নিবিষ্ট রূপ নেয় আবার কখনো ছাড়া ছাড়া অবস্থায় থাকে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বসতিসমূহের পারস্পরিক দূরত্ব কমে যায়। খাল, নদী বা রাস্তার সাহায্যে গ্রামের সীমানা নির্ধারণ চিহ্নিত করা হয় ।
৩. ভূমির বিন্যাস (Land order) : ভূমির উচ্চতা গ্রামে বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। কেননা, ভিটা বা সবচেয়ে উঁচু জমিতে বাড়িঘর তৈরি করা হয় সেখানে। ভরাট জমিতে অর্থাৎ, ভিটা সংলগ্ন চাষাবাদের জমির চেয়ে উঁচু কিন্তু ভিটার চেয়ে নিচু জমিতে লাগানো হয় বর্ষজীবী ফলের গাছ। গ্রামে ভূমির বিন্যাস বা ভূসম্পদের সূচকের প্রেক্ষিতে গ্রামীণ ধনীদরিদ্রের
পার্থক্য ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
৪. গ্রামের জনসংখ্যা (Population of the village) : গ্রামীণ জীবনে জনসংখ্যার প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন্ কোন গ্রামের জনসংখ্যা অধিক বৃদ্ধি পায়, তখন তাকে শহর এবং আরও বৃদ্ধি পেলে তাকে সিটি (City) বলে চিহ্নিত করা হয়। জনসংখ্যার চাপ বেশি থাকার কারণে গ্রামের পারস্পরিক দূরত্ব ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। নদীপ্রধান অঞ্চলে জনসংখ্যা
বেশি থাকলেও পাহাড়ি এলাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব খুবই কম।
৫. গ্রাম প্রশাসন (Village Administration) : বাংলাদেশে গ্রাম পর্যায়ে সরাসরি কোন প্রশাসনিক অবকাঠামো নেই। তবে এখন প্রতিটি ইউনিয়নে গঠিত হয়েছে ৯টি করে গ্রাম সরকার। গ্রামের (প্রকৃতপক্ষে ওয়ার্ডের) ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হবেন এর প্রধান এবং সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত মহিলা সদস্যকে করা হয়েছে ভূমি উপদেষ্টা।
গ্রাম সরকারের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা নেই যা ইউনিয়ন পরিষদের রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের কাজের পরিধি সীমিত। এর প্রধান কারণ অর্থাভাব। ক্ষমতা ও দায়িত্বে পরিধি সুনির্দিষ্ট না করে উপজেলা পরিষদ গঠিত হলে তার সাথে নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ ও গ্রাম সরকারের পারস্পরিক সম্পর্ক জটিল রূপ ধারণ করবে তাতে সন্দেহ নেই।
৬. গ্রামীণ অর্থনীতি (Rural economy) : গ্রামে কৃষি উৎপাদনের সাথে সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আবশ্যক। উৎপাদিত দ্রব্যের বাজারজাতকরণের সঠিক সুবিধা না থাকলে যত বেশি উৎপাদনই কৃষক করুক না কেন, দরিদ্রতার করালগ্রাসে তাকে আবদ্ধ থাকতে হয়। হাট, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয়ের সুযোগ করে দেওয়া এবং একই সাথে শহর থেকে আসা বিভিন্ন সামগ্রী সেখানে পাওয়া যায়। গ্রামীণ পরিসরে বাজারের চেয়ে হাটের গুরুত্ব অনেক বেশি। এছাড়াও বিভিন্ন পেশার সৃষ্টি, কুটিরশিল্পের উন্নতি, কাঁচামাল সরবরাহ, মূলধন ও সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থার প্রয়োজন । যুগপযোগী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রাম বিকাশে অত্যাবশ্যক।৭. গ্রামীণ বিপণন (Rural marketing) : গ্রামের বিপণন ব্যবস্থাকে দু’টি আঙ্গিকে তুলে ধরা যায়, যথা :
যাতায়াত ও গুদামজাতকরণ।
i. যাতায়াত (Communication) : গ্রামে তিন ধরনের যাতায়াত ব্যবস্থা দেখা যায়। যেমন- স্থলপথ, জলপথ ও রেলপথ। দুর্লভ পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য একদিকে উপকরণের উচ্চমূল্য, অথচ উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ মূল্য না পাওয়ার কারণে গ্রামে উৎপাদন ব্যবস্থা ও বিপণন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
ii. গুদামজাতকরণ (Storing goods) : গ্রামীণ বিপণন ব্যবস্থার উন্নতি করতে গুদামজাতকরণের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। গ্রামে সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা একদম নেই এ কথা বলা যাবে না, তবে প্রয়োজনের তুলনায় এত কম যে এর ভূমিকা সম্পর্কে প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশে মোট গুদামজাতকৃত খাদ্যশস্যের তিন
চতুর্থাংশের বেশি কৃষকেরা নিজেরাই বাড়িতে রাখে। তবে এদের রাখার পদ্ধতি একেবারেই সনাতনী।
৮. সামাজিক কাঠামো (Social structure) : বাংলাদেশের গ্রাম সমাজের কাঠামো বিশ্লেষণে গ্রামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ক্ষমতার বণ্টন ও নেতৃত্ব, সমাজিকরণ ব্যবস্থা, আচার অনুষ্ঠান, গ্রাম সমাজের স্তরবিন্যাস এবং গ্রামের সাথে অন্যদের সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয় স্থান পায়। গ্রামের কাঠামোগত বিভাজন মূলত অর্থনৈতিক কারণেই উদ্ভূত। বৈবাহিক
সম্পর্কের মধ্যদিয়ে এখানে সামাজিক সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনায় ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য ও সাম্প্রতিক কালের পরিবর্তনের ধারা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিত্বকারী গ্রামের রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। একটি কৃষক সমাজে সাধারণত যেসব
বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান, তার অধিকাংশই এ দেশের গ্রাম বাংলার সমাজ জীবনে পরিলক্ষিত হয়। তাই বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড বহুলাংশেই ঐতিহ্যিক এবং অনগ্রসর ধারায় পরিচালিত। তবে সমাজ স্থিতিশীল নয়, গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। তাই সাম্প্রতিক কালে দ্রুত শহরায়ণ, শিল্পায়ন ও আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার
ফলশ্রুতিতে গ্রামীণ ঐতিহ্যিক জীবনযাত্রা ও কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।