বরকতুলাহর স্বজ্ঞাবাদ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, অতীন্দ্রিয় অনুভবশক্তি বা স্বজ্ঞা সম্পর্কে বরকতুল্লাহর ধারণা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বরকতুল্লাহর দর্শনে স্বজ্ঞার পরিচয় দাও।
অথবা, বরকতুল্লাহর স্বজ্ঞা সম্পর্কীয় মতের মূল্যায়নমূলক আলোচনা কর।
উত্তর ভূমিকা : বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালের চিন্তাবিদদের মধ্যে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছেন। তাঁর রচিত ‘পারস্য প্রতিভা’ গদ্য সাহিত্য তাঁর এক অমূল্য অবদান। তবে দার্শনিক হিসেবে তাঁর খ্যাতির উৎস হলো ‘মানুষের ধর্ম’ নামক তাঁর রচিত দার্শনিক গ্রন্থ। ছয়টি প্রবন্ধের সমন্বয়ে রচিত গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালে কলকাতায়। ১৯৫০ সালে গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ঢাকায়। ১৯৫৯ সালে তিনটি নতুন প্রবন্ধ সংযোজনে গ্রন্থটির পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণও প্রকাশিত হয় ঢাকায়। বরকতুল্লাহ যেসব দার্শনিক বিষয়ে আলোচনার অবতারণা করেছেন এবং ঈর্ষণীয় দার্শনিক কলাকৌশল ও যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে তাঁর বক্তব্য পেশ করেছেন, সেগুলো হচ্ছে-
ক. বিশ্বময় চেতনার বাস্তবতা,
খ. অতীন্দ্রিয় অনুভব শক্তি বা স্বজ্ঞা,
গ. বিজ্ঞান, ধর্ম ও মানবকল্যাণ।
নিম্নে তাঁর অতীন্দ্রিয় অনুভব শক্তি বা স্বজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করা হলো :
অতীন্দ্রিয় অনুভব শক্তি বা স্বজ্ঞা : বরকতুল্লাহ বলেন, সাধারণত জ্ঞানের উৎস হচ্ছে আমাদের ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা প্রভৃতি। কিন্তু এগুলোর সাহায্যে পরম সত্তার সরাসরি জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। তাই বলে যে পরমসত্তা অজ্ঞেয় বা অজ্ঞাত এমন কথা বলা যায় না। এগুলো ছাড়াও মানব মনের অন্য একটি শক্তি আছে যার সাহায্যে পরমসত্তার জ্ঞান
লাভ করা যায়। বরকতুল্লাহর মতে, এ শক্তি হচ্ছে অতীন্দ্রিয় অনুভব শক্তি বা স্বজ্ঞা। এ স্বজ্ঞার সাহায্যে আমরা প্রাথমিকভাবে অবহিত
হই নিজেদের অস্তিত্ব ও চেতনা সম্পর্কে। এ স্বজ্ঞা যখন পরিণত অবস্থায় উপনীত হয়, তখন এর আলোকে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে পরমসত্তাকে এবং সে সত্তার সঙ্গে তার নিজের সম্বন্ধকে। জ্ঞানের বাহন হিসেবে স্বজ্ঞাকে নিয়ে দার্শনিক মহলে বিতর্কের শেষ নেই। যুক্তিবাদীরা এক তুড়িতে স্বজ্ঞাকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও প্রমাণের অযোগ্য বলে উড়িয়ে দেন। যুক্তিবুদ্ধির কাছে স্বজ্ঞার কোন জ্ঞানীয় মূল্য নেই। কিন্তু স্বজ্ঞাবাদীরা স্বজ্ঞাকে স্থান দেন যুক্তির ঊর্ধ্বে, অখণ্ড সে উচ্চতর
অনুভূতির পর্যায়ে যেখানে খণ্ডবুদ্ধি ও নৈয়ায়িক যুক্তির কোন প্রবেশাধিকার নেই।
দর্শনের ক্ষেত্রে এ বিতর্ক চলছে সুদীর্ঘকাল থেকে যার কোন মীমাংসার লক্ষণ আজও দেখা যায় না। তবে বরকতুল্লাহ জ্ঞানের বাহক বুদ্ধিকে অকেজো বলে বাতিল করে দেন নি। তিনি কেবলমাত্র বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা এবং অতীন্দ্রিয় অনুভূতির প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করেছেন। বরকতুল্লাহ স্বীকার করেন যে, ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত খণ্ড খণ্ড ও বিশৃঙ্খল জ্ঞানের উপকরণকে বুদ্ধি শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তার যোজনাশক্তি দ্বারা। তিনি বলেছেন, বুদ্ধি সমৃদ্ধ ও সংহত করে মানুষের জ্ঞানকে কিন্তু
জীবন শুধু বুদ্ধি নিয়েই গঠিত নয়। জীবনে আবেগ, অনুভূতি, উচ্ছ্বাস, ইচ্ছা আছে যেগুলোর খবর ভেদবুদ্ধি দিতে সক্ষম নয়। সেজন্য বুদ্ধির গুরুত্ব স্বীকার করেও আশ্রয়প্রার্থী হতে হয় অতীন্দ্রিয় সত্তার। এ স্বজ্ঞা বুদ্ধির চেয়ে উচ্চতর বটে, কিন্তু তাই বলে বুদ্ধি৷ বিরোধী নয়। অন্যকথায়, বরকতুল্লাহ বিজ্ঞানকে বিসর্জন দেননি। তিনি বরং বিজ্ঞানের প্রয়োজনে এর গুরুত্বের
কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, বিজ্ঞান মানুষের বুদ্ধিকে শানিত করে এবং বুদ্ধিস্তরে মানুষের জ্ঞানের সীমানা বিস্তৃত করে।
সমালোচনা : বরকতুল্লাহর ‘অতীন্দ্রিয় অনুভূতি’ তত্ত্ব সমালোচিত হয়েছে নানাভাবে। নিম্নে উল্লেখযোগ্য দুটি সমালোচনা উল্লেখ করা হলো :
১. আব্দুল কাদিরের সমালোচনা : বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্য সমালোচক আবদুল কাদির বলেছেন, মানুষের ধর্ম রচয়িতা অপরোক্ষানুভূতিবাদের সমর্থক। কিন্তু কথা হচ্ছে এ ইনটুয়িশনের প্রকৃতি কী? হেনরি পয়কার বলেছেন যে, এটি তাঁর সমস্ত
গাণিতিক উদ্ভাবনার মূলে আছে। অতএব, ইনটুয়িশন যে সৃষ্টিধর্মী, এটাই যে বহু বিজ্ঞানবিদের আরাধ্য মার্জিত সাধারণ
বুদ্ধি, এটা ধারণা করা যেতে পারে। কিন্তু বরকতুল্লাহ সাহেবের নিকট Activity অপেক্ষা Contemplation এর আবেদন বেশি। অন্যকথায়, তার Intuitionism হচ্ছে আসলে Traditional Mysticism যাকে বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, A lazy man’s Philosophy.
২. আব্দুল হকের সমালোচনা : দার্শনিক বরকতুল্লাহর দর্শনের সমালোচনা করতে গিয়ে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক আব্দুল হক বলেন, বরকতুল্লাহ অতীন্দ্রিয় অনুভব শক্তি বা সত্তার উপর আস্থা রেখেছেন যাকে প্রমাণ দিয়ে বুঝানো যায় না। এ অপ্রমাণযোগ্য দিয়ে আস্থা স্থাপন করে তিনি মূলত দর্শনকে বর্জন করেছেন।
মূল্যায়ন : স্বজ্ঞার স্বরূপ সম্পর্কে জনাব আবদুল কাদির উত্থাপিত প্রশ্নটি বহুল আলোচিত ও প্রবল বিতর্কিত। কে.
উব্লিউ. ওয়াইল্ড (Intuition) শব্দটির মোট একত্রিশটি স্বতন্ত্র অর্থ খুঁজে পেয়েছেন। বরকতুল্লাহ শব্দটি ব্যবহার করেছেন,
‘প্রগাঢ় মরমি অভিজ্ঞতা’র অর্থে। রাসেলের ‘A lazy man’s Philosophy’ অর্থে নয়। বস্তুত স্বজ্ঞা বলতে বরকতুল্লাহ সুফি বা যোগীদের নিছক নিষ্ক্রিয় ধ্যান-অনুধ্যানকে বুঝেননি, বুঝেছেন কাণ্ডজ্ঞান ও খণ্ডবুদ্ধি উত্তীর্ণ জ্ঞানের সে উচ্চতর ও অধিকতর ফলপ্রসূ বাহনকে, যার কথা বলেছেন বার্গসোঁ ও স্বজ্ঞাবাদী দার্শনিকগণ। জ্ঞানের এ বাহন কোন আপতিকভাবে প্রাপ্ত কিংবা সহজলভ্য ব্যাপার নয়। একে অর্জন করতে হয় সুকঠিন অনুশীলন ও অধ্যবসায়ের দ্বারা, বরকতুল্লাহর ভাষায় ‘কঠোর তপস্যার’ মাধ্যমে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বরকতুল্লাহ জ্ঞানের ক্ষেত্রে স্বজ্ঞাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন বুদ্ধি বা অভিজ্ঞতা দিয়ে যা সম্ভব নয় স্বজ্ঞার মাধ্যমে সে বিষয়ের জ্ঞানার্জন সম্ভব হয়ে
উঠে। তবে তিনি জ্ঞানের ক্ষেত্রে বুদ্ধিকে অস্বীকার করেননি, শুধু বুদ্ধির সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন। এছাড়া তিনি বিজ্ঞান বিরোধীও ছিলেন না। তিনি স্বীকার করেছেন যে, বিজ্ঞান মানুষের বুদ্ধিকে শানিত করে এবং বুদ্ধির স্তর মানুষের জ্ঞানের সীমানা বিস্তৃত করে। আর তাই সার্বিক বিচারে বরকতুল্লাহকে একজন বিশিষ্ট দার্শনিক হিসেবে অভিহিত করা যায়।