অথবা, কবি জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতার কাব্য সৌন্দর্য বিশ্লেষণ কর।
অথবা, ‘বনলতা সেন’ একটি অসামান্য আধুনিক কবিতা।’ উক্তিটির যথার্থতা প্রতিপন্ন কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ত্রিশোত্তর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। স্বাতন্ত্র্য ও কাব্যভঙ্গিতে তিনি অনন্য। রবীন্দ্রোত্তর বাঙালি পাঠকচিত্তে যদি কেউ প্রগাঢ় সাড়া এনে থাকেন, তিনি হলেন জীবনানন্দ দাশ। ‘বনলতা সেন’ তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা। গভীর প্রেমানুভূতি, ইতিহাস চেতনা, ভৌগোলিক ধারণা, উপমার ব্যবহার, ছন্দের নৈপুণ্য প্রভৃতির এক অপূর্ব সমন্বয় সাধিত হয়েছে এ কবিতায়। কবিতাটি সুখপাঠ্য এবং অনুভূতিপ্রবণ। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এবং কাব্যিক সুষমা একে বিশিষ্টতা দান করেছে।
ইতিহাস চেতনা : ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর ইতিহাস চেতনা। কবিতাটির প্রথম চরণে আছে হাজার বছর ধরে পথ চলার ঐতিহাসিকতা। এতে আছে মগধের রাজা বিম্বিসা, মৌর্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা অশোক, দাক্ষিণাত্যের বিদর্ভ নগরী, প্রাচীন বিদিশা নগরীর মোহময়ী রাত্রি এবং শ্রাবস্তীর কারুকার্যের কথা। ইতিহাসের এসকল প্রাচীন রাজা ও নগরী কাব্যিক সৌন্দর্যে বিভূষিত হয়ে উঠেছে এ কবিতায়।
ভূগোল চেতনা : ইতিহাস চেতনার পাশপাশি ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি ভূগোল চেতনায়ও সমৃদ্ধ হয়ে আছে। এ কবিতার পরিসরে ধরা পড়েছে সিংহল সমুদ্র মালয় সাগর এবং বাংলাদেশের শান্ত স্নিগ্ধ নাটোর শহরের প্রাচীনত্ব। জনৈক সমালোচক ‘বনলতা সেন’ কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, “দেশকালে সীমাবদ্ধ নাটোরের বনলতা সেনে’র পশ্চাতে রয়েছে ভূগোলের বিস্তৃতি এবং ইতিহাসের বেদ। এ দুই আয়তনের যোগে একটি ক্ষুদ্র লিরিক কবিতা পেয়েছে মহাকাব্যের ব্যাপ্তি।”
শাব্দিক সুষমা : জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘বনলতা সেন’ কবিতায় অপরিহার্য শব্দের ব্যবহার নিশ্চিত করে একে শাব্দিক শব্দগুলো ব্যবহার করে পাঠককে কয়েক হাজার সুষমায় ভূষিত করেছেন। ‘বিম্বিসা’, ‘অশোক’, ‘বিদর্ভ’, ‘বিদিশা’ ও ‘শ্রাবস্তী’ বছরের ইতিহাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আবার ‘সিংহল সমুদ্র’, ‘মালয় সাগর’ ও ‘নাটোর’ এ শব্দগুলো দিয়ে ভৌগোলিক সীমানা বেঁধে দিয়েছেন। ‘ক্লান্ত প্রাণ’, ‘সবুজ ঘাস’, দারুচিনি দ্বীপ’, ‘পাখির নীড়’, ‘শিশিরের শব্দ’, ‘রৌদ্রের গন্ধ’ প্রভৃতি শব্দ কবিতাটিকে কাব্যিক ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ করেছে।
উপমা প্রয়োগ : শব্দের যথার্থ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কবি যেমন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের পরিচয় রেখেছেন, তেমনি উপমা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তিনি বিস্ময়কর নিদর্শন স্থাপন করেছেন। বনলতা সেনের চুলকে তিনি তুলনা করেছেন অন্ধকার বিদিশা নগরীর রাত্রির সাথে, মুখকে তুলনা করেছেন শ্রাবস্তীর কারুকার্যের সাথে এবং চোখ তুলনা করেছেন পাখির নীড়ের সাথে। কবির ভাষায়- “চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য।”
এ কবিতায় সন্ধ্যা নেমেছে শিশিরের শব্দের মতন অর্থাৎ নিঃশব্দে। হাল ভাঙা দিশেহারা নাবিক স্বস্তি পেয়েছে যেমন সবুজ ঘাসে ঘেরা দারুচিনি দ্বীপ দেখে, কবির অশান্ত মনও তেমনি শাস্তি পেয়েছে বনলতা সেনকে দেখে।
ছান্দিক বৈশিষ্ট্য : সনেটের ষষ্ঠক এর মতো তিনটি স্তবকে বিন্যস্ত করে কবি তাঁর ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি রচনা করেছেন। অন্ত্যমিল সৃষ্টি করেছেন প্রথম-তৃতীয়, দ্বিতীয়-চতুর্থ এবং পঞ্চম-ষষ্ঠ চরণে। দ্বিতীয় স্তবকের প্রথম পঙক্তিতে দেখিয়েছেন মধ্যমিল ও অনুপ্রাসের দীপ্তি। যেমন- ‘চুল তাঁর কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’।
ভাব-সম্পদ : ভাব-সম্পদের দিক থেকে কবি জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ একটি স্বয়ংসমৃদ্ধ কবিতা। মানবসত্তার শাশ্বত অনুভূতি যে প্রেম-চেতনা সেই মধুর অনুভবকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠেছে এ কবিতা। নীড় সন্ধানী পুরুষকে দেয়া হয়েছেভ শাস্তি ও স্বস্তির সন্ধান। তাকে কবি দাঁড় করিয়েছেন এক শাশ্বত কল্যাণী নারীর নীড়ের মুখোমুখি। হাজার বছর ধরে সে যাকে খুঁজে ফিরছিল তাকে পাইয়ে দিয়েছেন কবি। প্রেম প্রীতি ও প্রেম দাত্রী এ দুই সত্তা পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে নির্জন অন্ধকারে। সৃষ্টিহয়েছে প্রেমের মিষ্টি মধুর অনুভূতি ও গুঞ্জন। এ অমূল্য ভাব সম্পদে সমৃদ্ধ ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি।
আধুনিক কবিতা হিসেবে ‘বনলতা সেন’ : স্বভাবকবি জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ একটি উৎকৃষ্ট আধুনিক কবিতা। এ কবিতার ভাব, ভাষা, শব্দচয়ন, অলঙ্কার, ছন্দ সবই আধুনিক। কিন্তু আধুনিক কবিতার যে অন্যতম উপাদান দুর্বোধ্যতা ও অশ্লীলতা তা এ কবিতায় নেই। সমিল অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত এ কবিতায় অন্তানুপ্রাস বিদ্যমান। একজন শান্তি প্রত্যাশী মানুষ সভ্যতার সুদীর্ঘ পথ বেয়ে আধুনিক সভ্যজগতে পৌছে শান্তির আঁধারের অন্বেষণে বিভোর। পথে চলতে চলতে সে তার প্রত্যাশিত মানবীর সন্ধান পেয়েছে নাটোর এসে। মানুষটির কল্পিত সে মানবীর নাম বনলতা সেন। এ ‘বনলতা সেন’ সৌন্দর্য ও শান্তির প্রতীক। প্রত্যেক পুরুষের সুখ ও স্বস্তির জন্য একটি একটি করে বনলতা সেন আবশ্যক। কবির অন্বেষণী মনের এ ভাব ও চিন্তা আধুনিক। এ কবিতায় কবি অনন্য উপমা ব্যবহার করেছেন। অপলক চোখ বুঝাতে তিনি ‘পাখির নীড়’ এবং নিঃশব্দতাকে বুঝাতে ‘শিশিরের শব্দ’ ব্যবহার করেছেন। এমন সুন্দর উপমা আধুনিক কাব্য সাহিত্যে একান্তই বিরল। তাই ভাব, ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার, উপমা, শব্দচয়ন এর যে কোন দিক থেকেই ‘বনলতা সেন’ একটি রসোত্তীর্ণ আধুনিক কবিতা।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কবি জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতা কাব্য সৌন্দর্যে ভরপুর এক অনন্য সৃষ্টি। বহুমাত্রিক উপকরণে সমৃদ্ধ বলেই এর বিশিষ্টতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের এক ভিন্ন স্বাদের সংযোজন, একটি অসামান্য আধুনিক কবিতা।