বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তৎকালীন পাকিস্তানে কী ধরনের তৎপর্য ও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল? আলোচনা কর।

অথবা, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ রাজনৈতিক অঙ্গনে কিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল? আলোচনা কর।
উত্তরা৷ ভূমিকা : ৭ মার্চ ভাষণে পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের জনতা মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৭ মার্চ ভাষণ ছিল পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিরূপণকারী ও স্বাধীনতার দিকনির্দেশনামূলক ঘোষণা। পৃথিবীর ইতিহাসে ৭ মার্চের ভাষণের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভাষণ ইতঃপূর্বে কোনো নেতা দিয়েছেন বলে জানা যায় না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণ গণতন্ত্রের জন্য ইতিহাসে অমর হয়ে
আছে, তেমনিভাবে ৭ মার্চ ভাষণ পৃথিবীর স্বাধীনতা কামী মানুষের নিকট অমর হয়ে থাকবে। ৭ মার্চ ভাষণে পূর্ব বাংলার জনতা মুক্তির নেশায় উদ্বেলিত হয়ে উঠে।
৭ মার্চ ভাষণের প্রতিক্রিয়া : ৭ মার্চ ভাষণের পর পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পূর্ব বাংলার মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
অন্যদিকে, পশ্চিম পাকস্তানি সামরিক জান্তা বাঙালিদের উপর দমন ও নিধনের ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ফলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল রূপ ধারণ করেছিল।
১. পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রতিক্রিয়া : পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সাথে একাত্ব ঘোষণা করে। ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় এক সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, আগামী কাউন্সিল অধিবেশন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ শুধু ছাত্রলীগ পরিচিত হবে। প্রত্যেক জেলা শহরে প্রাথমিক শাখা পর্যন্ত শাখার সভাপতিকে
আহ্বায়ক, সাধারণ সম্পাদককে সদস্য সচিব করে এবং ৯ জন সদস্যসহ সর্বমোট ১১ সদস্য বিশিষ্ট ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এছাড়া পাকিস্তানি পতাকা প্রদর্শন, পাকিস্তানি সঙ্গীত বাজানো এবং উর্দু ছায়াছবি প্রদর্শন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
২. পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিক্রিয়া : ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ পত্রের মাধ্যমে ৭ মার্চ ভাষণকে পূর্ব পাকিস্তান
কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন করেন। স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার আহবান জানায়। তারা সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা, নিরীহ ও নিরস্ত্র লোকদের হত্যার তদন্ত করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ৭ মার্চের ভাষণের সাথে একাগ্রতা ঘোষণা করে।
৩. মওলানা ভাষানীর (ন্যাপ) এর প্রতিক্রিয়া : ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ মওলানা ভাসানী ৭ মার্চ ভাষণের সাথে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, “প্রিয় দেশবাসী, আজ আমি ৭ কোটি পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে এ জরুরি আহ্বান জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে, আপনারা দল, মত, ধর্ম ও শ্রেণি নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ একত্রে এবং একযোগে সাধারণ কর্মসূচি
গ্রহণ করুন, যার মূল লক্ষ্য হবে ২৩ বছরের অমানুষিক এবং শোষণকারী শাসকগোষ্ঠীর করাল গ্রাস থেকে পূর্ব বাংলাকে সম্পূর্ণ ও চূড়ান্তভাবে সার্বভৌম ও স্বাধীন করা। তার এই বক্তব্য ৭ মার্চের সাথে একগ্রতার প্রকাশ।
৪. পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া : ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের প্রতিক্রিয়া ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন এক প্রচার পত্রের মাধ্যমে শোষণমুক্ত স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েমের দুর্বার গণ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। রাজনৈতিক প্রচার অব্যাহত রাখা। গ্রাম অঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে উহা ছড়িয়ে দেওয়া, দাঙ্গা হাঙ্গামা উসকানি
প্রতিরোধ করা, শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং সংগ্রামের সফলতার জন্য গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য গঠনে জোরালো ভূমিকা পালনের আহবান জানায়।
৫. পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রতিক্রিয়া : ‘৭০ এর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বৈধ ক্ষমতার মালিক। কিন্তু এ নির্বাচনে ফলাফলের পাকিস্তান পিপলস পার্টির ভূমিকা ছিল অগণতান্ত্রিক ও নেতিবাচক। ৭ মার্চ ভাষণের পর দলটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে যখন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল পূর্ব বাংলার মানুষ স্বাধীনতার প্রস্তুতি
নিচ্ছিল তখন। তখন ১৫ মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুই সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা দেবার
তত্ত্ব ঘোষণা করেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ দল এবং তারা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধি। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি। এরূপ পরিস্থিতিতে তিনি
ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব দেন এবং দুই সরকার দুই প্রধানমন্ত্রীর দাবি উত্থাপন করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ঘোষণা ছিল পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ৭ মার্চ ভাষণ প্রদানের পর পূর্ব বাংলার অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এটি সমর্থন করে বিবৃতি প্রদান করে। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল ৭ মার্চের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেয়। পাকিস্তানের সামরিক সরকার ৭ মার্চ ভাষণের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় অসহযোগ আন্দোলন দমনের জন্য সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়। ৭ মার্চ
ভাষণের ফলে পূর্ববাংলায় মুক্তি যুদ্ধের যে প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় তা ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা হলে চূড়ান্তরূপে প্রকাশ ঘটে। পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের মানুষ পাকবাহিনীর প্রতিরোধ শুরু করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে ৭ মার্চ ভাষণ মুক্তিযোদ্ধাদের মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল ।