অথবা, ব্যবহারিক মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রগুলো লিখ। অথবা, প্রায়োগিক মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রগুলো কী কী? উত্তরা৷
ভূমিকা : মনোবিজ্ঞানের একটি রাস্তব এবং যুগোপযোগী শাখা হলো ফলিত মনোবিজ্ঞান। এ শাখা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবমুখী সমস্যা সমাধানের জন্য কার্য পরিচালনা করে থাকে। মানুষের প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যবহারিক কল্যাণে মনোবিজ্ঞানকে যথাযথ প্রয়োগ করার জন্য বিভিন্ন প্রকার পদ্ধতি বা কৌশল সৃষ্টি করাই ফলিত মনোবিজ্ঞানের কাজ। ফলিত মনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের পরীক্ষিত তথ্য, তত্ত্ব এবং মনোবৈজ্ঞানিক মূলনীতিসমূহকে প্রয়োগ করে ব্যক্তির নানা প্রকার সমস্যা সমাধানের চালায়।
ফলিত মনোবিজ্ঞানের শাখা বা ক্ষেত্রসমূহ: মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে গিয়ে উদ্ভব হয়েছে নিত্য নতুন জ্ঞানের ক্ষেত্র। মানুষের আচরণ তার কর্ম পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে যে বিশেষ রূপ লাভ করে তার সার্থক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়ার জন্য ফলিত মনোবিজ্ঞানের মধ্যে নতুন নতুন শাখা বিকাশ লাভ করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি শাখা হলো :
১. শিল্প মনোবিজ্ঞান : ফলিত মনোবিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা শিল্প মনোবিজ্ঞান। মানুষের জীবনের একটি বৃহৎ পরিসরের ক্ষেত্র হলো শিল্পক্ষেত্র। তাই মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান এই ক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী। মানুষের আচরণের যেসব দিক নিয়ে আলোচনা করে, যা পণ্য ও সেবার উৎপাদন, বণ্টন এবং ভোগের সাথে সম্পর্কিত।
শিল্প মনোবিজ্ঞানের প্রধান এবং ফলপ্রসূ কার্যগুলো হলো : শিল্পকারখানায় কর্মী নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, পদোন্নতি, মূল্যায়ন, শ্রমিক অসন্তোষ দূরীকরণ, ভালো উৎপাদনের জন্য কর্ম পরিবেশ সৃষ্টি, ক্লান্তি এবং দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করা।
২. শিক্ষা মনোবিজ্ঞান : ফলিত মনোবিজ্ঞানের আরেকটি অন্যতম শাখা হলো শিক্ষা মনোবিজ্ঞান। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের প্রায় সবক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের ব্যবহার বা প্রয়োগ খুব বেশি হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে এর প্রয়োগ তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি, বর্তমানে কোনো বিষয় সঠিকভাবে শিক্ষণ করা, স্মৃতি- বিস্মৃতি, শিক্ষাদানের কার্যকর কৌশল উদ্ভাবন, ছাত্রদের মূল্যায়ন, তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত পার্থক্য নির্ণয়, তাদের প্রেষণা, উপযোজন, শ্রেণিকক্ষের নিয়ন্ত্রণ, প্রভৃতি সবকিছুতেই মনোবিজ্ঞানের ব্যাপক প্রয়োগ হচ্ছে। মনোবিজ্ঞানের এ শাখায় বিশেষভাবে শিশুদের নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করা হয়।
৩. শরীরতত্ত্বমূলক মনোবিজ্ঞান : শরীরতত্ত্বমূলক মনোবিজ্ঞান ফলিত মনোবিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা। শরীরতত্ত্বমূলক মনোবিজ্ঞান ফলিত মনোবিজ্ঞানের সেই শাখা, যে শাখায় মানসিক প্রক্রিয়াকে দৈহিক বা বাহ্যিক গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে বর্ণনা করে। মস্তিষ্ক, ইন্দ্রিয়, পেশী, গ্রন্থি, স্নায়ুতন্ত্র হলো এ শাখার বিষয়বস্তু। সংবেদন, আবেগ, প্রেষণা, প্রত্যক্ষণ প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়া ও মানসিক অবস্থার সাথে দৈহিক গঠনের সম্পর্ক নির্ণয় করাই শরীরতত্ত্বমূলক মনোবিজ্ঞানের প্রধান উদ্দেশ্য।
৪. মানসিক রোগ চিকিৎসা সম্বন্ধীয় মনোবিজ্ঞান : সুস্বাস্থ্য বলতে বুঝায় সুস্থ দেহ এবং সুস্থ মন। তাই মানুষের শরীরের মতো মানুষের মনও অসুস্থ হয়। এ অসুস্থ মনের রোগ নির্ণয় মনকে সুস্থ করার লক্ষ্যে সৃষ্টি হয়েছে মনোবিজ্ঞানের আরেকটি ব্যবহারিক শাখা অস্বভাবী মনোবিজ্ঞান। মনোবিজ্ঞানের এ শাখা প্রথমে রোগীকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে তারপর রোগীর লক্ষণগুলোর মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়।
৫. নির্দেশনা মনোবিজ্ঞান : ফলিত মনোবিজ্ঞানের এ শাখা মানুষের জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান, পরিবেশের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান এবং ব্যক্তির অন্তর্মুখী বিকাশে সাহায্য করে। দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে মানুষ প্রতিনিয়তই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে এবং এর সমাধানের জন্য অন্য ব্যক্তির সহায়তা কামনা করছে। যখনই মানুষ চলার পথে একদম আটকে যাচ্ছে, তখনই অন্য ব্যক্তির নির্দেশনা গ্রহণ করছে এবং এর থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে।
।৬. মানব প্রকৌশল মনোবিজ্ঞান : মনোবিজ্ঞান এবং প্রকৌশল বিদ্যার একত্রিত কার্যক্ষেত্র হলো মানব প্রকৌশল । ফলিত মনোবিজ্ঞানের এ শাখার প্রধান লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হলো যন্ত্রকে মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরি করা। বর্তমানে কম্পিউটার যন্ত্রটি মানুষের কার্যক্রমের আদলে আবিষ্কৃত হয়েছে, যা মানুষের কাজকে অনেক দ্রুত করেছে এবং কমিয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহ, যন্ত্রপাতি তৈরিতে মানব প্রকৌশলের গুরুত্ব সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করেছে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান প্রয়োগ করা হয়। মানুষের প্রয়োজন এবং জীবন পরিচালনার তাগিদেই মনোবিজ্ঞানের সকল শাখার উদ্ভব হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেকটি বিজ্ঞানেরই তাত্ত্বিক দিকের পাশাপাশি ব্যবহারিক দিকও বিদ্যমান। এর ব্যবহারিক দিকই হচ্ছে ফলিত বিজ্ঞান। মনোবিজ্ঞানও এর আওতা বহির্ভূত নয়। প্রাত্যহিক জীবনে মনোবিজ্ঞানের ফলিত বা ব্যবহারিক দিকের গুরুত্ব অপরিসীম। মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ফলিত দিককে অনুসরণ করে মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে উন্নতি লাভ করেছে। অতএব ফলিত মনোবিজ্ঞান একটি সার্থক মনোবিজ্ঞান ।