অথবা, পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা বর্ণনা কর।
উত্তর ভূমিকা : আধুনিক যুগে প্রতিটি রাষ্ট্রই তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামোসহ পুরো ব্যবস্থার উপর খুবই গুরুত্বারোপ করে থাকে। কেননা অর্থনীতিই একটি রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রবাদী অর্থব্যবস্থাই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। তবে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদ সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দুটি রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থা, বিভিন্ন দিক থেকে এদের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা : পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদ সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দুটি রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থা। বিভিন্ন দিক থেকে এদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে পার্থক্যগুলো উল্লেখ করা হলো :
১. আয় কটনের ক্ষেত্রে পার্থক্য : সমাজতন্ত্রে প্রত্যেক ব্যক্তি তার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করবে এবং কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাবে। আয়ের এ বণ্টন নীতির ফলে সমাজতন্ত্রে আয় ও সম্পদ বণ্টনের সমতা নিশ্চিত হয়। এর ফলে জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হয়। অন্যদিকে, ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় জাতীয় আয়ের সুষ্ঠু রটন হয় না। এখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে বণ্টনের কোন সুযোগ নেই।
২. বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য : সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এখানে সকল প্রকার শোষণ ও বঞ্চনার অবসান কামনা করা হয়। অন্যদিকে, ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় শোষণহীন, শ্রেণিহীন সমাজ গড়ার কোন পদক্ষেপ নেই । মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিরা শ্রমিকদের শোষণের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে।
৩. শ্রেণির অস্তিত্বগত পার্থক্য : ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় শ্রেণিচেতনা বিদ্যমান। মার্কসের মতে, এ শ্রেণি দু’প্রকার। যথা : মালিক শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণি। এদের একটি শাসকগোষ্ঠী এবং অন্যটি শাসিত বা শোষিত গোষ্ঠী। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় কোন শ্রেণির অস্তিত্ব নেই। এখানে “All are equal to law.”
৪. ভোক্তার পছন্দের দিক থেকে : পুঁজিবাদে উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা থাকে। একই জিনিস বিভিন্ন মানের উৎপাদিত হয়। ক্রেতা তার পছন্দমতো যে কোনটি সে ক্রয় করতে পারে। কিন্তু সমাজতন্ত্রে ক্রেতাদের কোন স্বাধীনতা থাকে না। তাদের পছন্দ-অপছন্দের কোন মূল্য দেয়া হয় না। সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীনে যা উৎপাদন করা হয় ক্রেতাকে তা কিনতে হয়।
৫. স্বাধীনতার ক্ষেত্রে পার্থক্য : ধনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ধনসম্পদ অর্জনের জন্যও মানুষের মধ্যে অবাধ প্রতিযোগিতা তথা স্বাধীনতার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু সমাজতন্ত্রে দেশের সবার স্বার্থে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। এখানে ব্যক্তিস্বাধীনতার কোন মূল্যায়ন করা হয় না।
৬. লক্ষ্যের দিক থেকে পার্থক্য : পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিপতিগণ অধিক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে যান। সমাজের কল্যাণের প্রতি তারা ভ্রুক্ষেপ করেন না। অপরদিকে, সমাজতন্ত্রে সমাজের কল্যাণের দিকে নজর রেখে উৎপাদন কাজ পরিচালনা করা হয়। এখানে রাষ্ট্রীয় কল্যাণসাধনই প্রধান উদ্দেশ্য থাকে ।
৭. মালিকানা সম্পর্কে মতপার্থক্য : পুঁজিবাদে ব্যক্তিমালিকানা স্বীকার করে নেয়া হয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ধনবান ব্যক্তিরাই দেশের ধনসম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে, সমাজতন্ত্রে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় মালিকানা গ্রহণযোগ্য। এখানে ধনসম্পদ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীনে থাকে।
৮. মূল্য ব্যবস্থার পার্থক্য : পুঁজিবাদী
অর্থব্যবস্থার একটি অন্যতম দিক হলো নিয়ন্ত্রণবিহীন মূল্য ব্যবস্থা। অপরদিকে,
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে।
৯. শ্রমিকদের প্রতি আচরণের পার্থক্য : পুঁজিবাদে শ্রমিকদেরকে শোষণ করা হয়। ন্যায্য পাওনা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হয় । পক্ষান্তরে, সমাজতন্ত্রে প্রত্যেকে তাদের যোগ্যতা অনুসারে কাজ করে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পারিশ্রমিক পায়। এখানে মালিক ও শ্রমিক বলে কোন শ্রেণির অস্তিত্ব নেই।
১০. কর্মসংস্থানের পার্থক্য : পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় পুঁজি এক শ্রেণির লোকের হাতে থাকে বলে এক শ্রেণি প্রচুর সম্পদের মালিক, অন্যটি হয় অসহায় শ্রেণি। তাই এখানে অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্ব দেখা যায়। কিন্তু সমাজতন্ত্রে পরিকল্পিত অর্থব্যবস্থার দ্বারা অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্ব রোধ করা সম্ভব।
১১. ভূমিকা পালনের দিক থেকে : পুঁজিবাদে পুঁজিপতির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অপরপক্ষে, সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের বা সরকারের ভূমিকা ও নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১২. মুনাফা অর্জনে পার্থক্য : পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মুনাফা অর্জনই উৎপাদন কার্যের মূল লক্ষ্য। এখানে ধনিক শ্রেণি বা পুঁজিপতিদের স্বার্থেই উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু থাকে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মুনাফার কোন স্থান নেই। সামাজিক প্রয়োজন মিটানোর লক্ষ্যে উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়।
১৩. উৎপাদন ও ভোগের দিক থেকে : পুঁজিবাদে উৎপাদন ও ভোগের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য বিধানের ব্যবস্থা করা হয় না। পক্ষান্তরে, সমাজতন্ত্রে উৎপাদন ও ভোগের মধ্যে যথাযথ সামঞ্জস্য রক্ষা করা হয়।
১৪. অপচয় রোধে পার্থক্য : পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদকগণ ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, যার ফলে বিজ্ঞাপন বা প্রচার বাবদ প্রচুর অর্থ অপচয় হয়। পক্ষান্তরে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় উৎপাদন হয় বিধায় এখানে বিজ্ঞাপন বা প্রচারে তেমন কোন অর্থ অপচয় হয় না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদ দুটি বিপরীতধর্মী অর্থব্যবস্থা। এ দু’ধরনের অর্থব্যবস্থার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও এ দুটি অর্থব্যবস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গুরুত্বসহকারে মর্যাদা পেয়েছে। দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক প্রভৃতি প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে সে দেশের উপযোগী অর্থব্যবস্থা গড়ে উঠে। কিন্তু বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে এ দুই অর্থব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গুরুত্বসহকারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।