পাবর্ত্য চট্টগ্রামের যে কোনো একটি এথনিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবন আলোচনা কর।

অথবা, চাকমা এথনিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক জীবনধারা আলোচনা কর।
অথবা, চাকমাদের জীবন ধারা সম্পর্কে লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : নৃতত্ত্বে এথনিক গোষ্ঠী বা বর্ণগোষ্ঠী ও নরগোষ্ঠী একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত নরগোষ্ঠী ও বর্ণগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয় না। এমনকি জনবিজ্ঞানেও প্রত্যয় দু’টি পরস্পরের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে । অতএব এথনিক গোষ্ঠী বা বর্ণগোষ্ঠী প্রত্যয়টি নৃতাত্ত্বিক পঠন-পাঠনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের জনগোষ্ঠীতে নানা ধরনের বর্ণগোষ্ঠী বিদ্যমান এবং জাতীয় সংহতি, সামাজিক, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও
অর্থনৈতিক প্রগতির প্রশ্নে এদের অবস্থান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এথনিক জনগোষ্ঠী হিসেবে চাকমা সম্প্রদায়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন : বাংলাদেশে ছোট বড় অনেকগুলো বর্ণগোষ্ঠী বা এথনিক গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাস করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য বর্ণগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা সম্প্রদায় অন্যতম। নিম্নে চাকমা সম্প্রদায়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. নামকরণ : চাকমা নামকরণটির একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। অধিকাংশ বয়স্ক ও শিক্ষিত চাকমারা নিজেদেরকে ‘চাকমা’ বলতে পছন্দ করেন। অথচ তাদের অনেকেই ‘চাঙমা’ নামে নিজেদেরকে পরিচিত করতে আগ্রহী।
তবে আধুনিক যুবসমাজ এবং অধিকাংশ জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে চাকমার চেয়ে চাঙমা নামকরণে বেশি আগ্রহী। অর্থাৎ যুবসমাজ চাঙমা নামকরণে এবং বয়স্ক সমাজ চাকমা নামকরণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
২. উদ্ভবের ইতিহাস : চাকমাদের উদ্ভব বিশেষ করে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি ভূমিতে। তাদের উদ্ভব নিয়ে বেশ ঘটনাবহুল আলোচনা রয়েছে। অনেকে মনে করেন তারা একদা চম্পক নগরের অধিবাসী ছিল, যেটা
ভারতের একটি জায়গার (চম্পক) নামকরণ থেকে চাকমা নামকরণ করা হয়েছে। একটি ঘটনায় বলা হয়েছে যে, চম্পক নগর থেকে একজন চাকমা রাজপুত দেশ জয়ের লক্ষ্যে মায়ানমারের আরাকান রাজ্যে আগমন করেন, যা থেকে চাকমা নামকরণ করা হয়। তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে এবং ক্রমশ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পার্বত্য জেলায় স্থানান্তরিত হয়।
৩. চাকমা জনসংখ্যা : আমরা জানি বাংলাদেশে প্রায় ৩১ পদের উপজাতি বসবাস করে, তবে তাদের মধ্যে সংখ্যাধিক্যের দিক থেকে চাকমাদের অবস্থান সবচেয়ে বেশি। ১৯৯১ সালের শুমারি অনুযায়ী তাদের সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ। তাদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। পার্বত্য জেলাগুলোর উপজাতিদের সাথে এস্টিমেট করলে চাকমাদেরকে সমগ্র
উপজাতির অর্ধেক বলে গণ্য করা হয়। তবে সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলের ৩০% চাকমা বলে মত প্রকাশ করা হয়।
৪. চাকমাদের ভাষা : পূর্বে চাকমারা আরাকানী উপভাষায় কথা বললেও তারা এখন বাংলা উপভাষায় কথা বলে। বাংলা অক্ষরে উপভাষা লিখে থাকে। তারা আরাকান রাজ্যে প্রায় পাঁচশত বছর থাকাকালীন অবস্থায় আরাকানী ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়। পরবর্তীতে তারা ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বাংলা ভাষা শিখতে সক্ষম হয়।
৫. নরগোষ্ঠীগত পরিচয় : চাকমাদের মধ্যে নরগোষ্ঠীগত একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়, যেখানে মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। তবে তাদের মধ্যে চীনা মঙ্গোলয়েডের যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষণীয়। উচ্চতার দিক থেকে চাকমারা বেঁটে ও মাঝারি ধরনের, তবে বেশ শক্তিশালী ।
৬. ধর্মীয় অনুভূতি : তারা মূলত বৌদ্ধধর্মানুসারী। তারা বৌদ্ধধর্মকে নিজেদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মূলকেন্দ্র ধরে বৌদ্ধ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছে। চাকমাদের গ্রামীণ অঞ্চলে বৌদ্ধ মন্দির ‘ক্যাং’ দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিটি ক্যাং এ বৌদ্ধভিক্ষু বা শ্রামন থাকে, যিনি বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব প্রদান করেন। মৈত্রী বিহার, আনন্দ বিহার, বমড়ান্তের বিহার, রাজবসবিহার প্রভৃতি বৌদ্ধ মন্দিরে তারা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে।
৭. চাকমা সমাজ : চাকমা সমাজও পরিবারভিত্তিক। তবে পরিবারের চেয়ে একটু বৃহৎ পর্যায়ে রয়েছে গোষ্ঠী বা মৌজা। তবে আদাম বা গড়া তাদের একটু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গড়ে উঠে। এরপর গ্রাম বা মৌজার স্থান। চাকমা সমাজ বা চাকমা সার্কেল গঠিত হয় মৌজার সমন্বয়ে। চাকমাদের পরিবার পিতৃতান্ত্রিক অর্থাৎ পূর্বপুরুষরা এ পরিবারের প্রধান এবং যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে থাকে পুরুষ। সম্পত্তি, বংশপরিচয় সবই পিতার অনুসরণে হয়ে থাকে।
৮. চাকমাদের বিবাহ উৎসব : যদিও বলা হয় চাকমাদের ৭ পুরুষের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ কিন্তু তারা এটি মেনে চলে না। তাদের মধ্যে কাজিন বিবাহ পদ্ধতি প্রচলিত আছে। তবে প্যারালাল কাজিন বা খালাত ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ অনুমোদিত আছে। আপন চাচাত
যেখানে একজন স্বামী কতজন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারবে তা নির্দিষ্ট করে বলা নেই। তাদের সমাজে বিবাহ অন্তর্বিবাহ ও বহির্বিবাহ প্রচলিত রয়েছে। তবে তাদের মধ্যে খুব কমই বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। স্ত্রীকে প্রদত্ত পোশাক ও গহনার দাবি করতে পারে। তবে স্বামী দোষী হলে তাকে জরিমানা করা হয়। ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। তাদের মধ্যে বহুস্ত্রী বিবাহ অনুমোদিত, অনুমোদিত এবং
৯. গ্রাম বা মৌজা : কতকগুলো আদাম মিলে গঠিত হয় চাকমা গ্রাম বা মৌজা, যার প্রধানকে বলা হয় হেডম্যান। চাকমা রাজার সুপারিশে ডেপুটি কমিশনার হেডম্যানকে নিযুক্ত করে থাকেন। এক্ষেত্রে তেমন কোনো স্বতঃসিদ্ধ বিধিমালা নেই। তবে যোগ্য পুত্র থাকলে তাকে হেডম্যান করা যায়।
১০. চাকমা অর্থনীতি : চাকমারা নিম্নোক্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত থাকে :
ক. পশুপালন, মোরগ মুরগি, শূকর পালন।
খ. শাকসবজি সংগ্রহ করে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে।
গ. বাঁশ ও বেত দিয়ে কুটির শিল্পজাত দ্রব্য প্রস্তুত করে।
ঘ. জুমচাষের মাধ্যমে কৃষিকাজ করা, যার দ্বারা খাদ্য উৎপাদন করা হয়।
১১. চাকমাদের শিক্ষা : জরিপে দেখা গেছে সমগ্র ট্রাইবের মধ্যে চাকমারা ৯৯% শিক্ষিত আর বাকি ১% অন্যান্যরা। তারা উপজাতিদের মধ্যে কিছুটা সচেতন ও সভ্য। তারা বর্তমানে উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে অঞ্চলে স্কুল, কলেজ প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করা হচ্ছে।
১২. চাকমাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া : সাধারণত তাদের সমাজে মৃতদেহ পোড়ানো হয়। তবে সাত বছরের কম বয়সীদের কবর দেওয়ার প্রথা প্রচলিত রয়েছে। তাদের সমাজে বুধবারে মৃতদেহ পোড়ানোর কোনো বিধান নেই।
১৩. চাকমাদের পরিবার : চাকমা পরিবার পিতৃতান্ত্রিক। অর্থাৎ চাকমা পরিবারের ক্ষমতা স্বামীর হাতে অথবা পুরুষের হাতে ন্যস্ত । চাকমা সম্পত্তি, বংশপরিচয় পিতা থেকে পুত্রে বর্তায়। চাকমা দম্পত্তি বিয়ের পর স্বামীর পিতৃগৃহে বা পিতার গ্রামে গিয়ে বসবাস করে।
ভাগ করে।
১৪. চাকমাদের খাদ্য ও বাসস্থান : ভাত ও মদ হলো চাকমাদের প্রধান আহার্য দ্রব্য। চাকমারা নিজেরাই মদ তৈরি করে। মাটি থেকে ছয়ফুট উঁচুতে এরা ঘর তৈরি করে, সেখানে বসবাস করে। ঘরটিকে তারা কয়েকটি সচাকমারা ঘরে উঠার জন্য মই ব্যবহার করে, তাদের প্রধান কামরাটি ৪০′×২৫’ ফুট এবং অন্যান্য কা
২৫′×৫৫’ ফুট হয়ে থাকে গার আয়তন
১৫. পোশাক পরিচ্ছদ : চাকমা পুরুষরা পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে ধুতি, পাঞ্জাবি ইত্যাদি ব্যবহার করে। আবার পুরুষেরা কখনও মাথায় পাগড়ি ব্যবহার করে। তাদের মধ্যে কোট ব্যবহার করার রীতিও লক্ষণীয়। পিনধন, খাদী, খালাং ইত্যাদি পোশাক চাকমা নারীরা ব্যবহার করে থাকে। তারা লাল, নীল, ডোরাকাটা কাপড় ব্যবহার করে। চাকমাদের মধ্যে শিক্ষিত নারীরা শাড়ি ও রাউজ পরিধান করে।
১৬. চাকমা গোষ্ঠী জীবন : বিভিন্ন গোষ্ঠীতে চাকমা সমাজ বিভক্ত। একশত পঞ্চাশটি গোষ্ঠী নিয়ে চাকমা সমাজ গড়ে উঠেছে। গোষ্ঠীকেন্দ্রিক লোকেরা আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ। অর্থাৎ চাকমা সমাজ জ্ঞাতিভিত্তিক সমাজ। আবার এ জ্ঞাতি গোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন গোছা নিয়ে গঠিত। চাকমা সমাজ এরকম বিভিন্ন গোছা নিয়ে গঠিত হয়েছে।
১৭. সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস : চাকমারা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। তাদের পারিবারিক কাঠামো ছিল পিতৃতান্ত্রিক। চাকমারা ছিল পৌত্তলিক সমাজভুক্ত। গোত্রপ্রীতি ছিল তাদের মধ্যে প্রবল। গোত্র এবং উপজাতির প্রত্যেকে একে অপরের সাথে ভ্রাতৃ সম্পর্কের মতোই পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ। তবে বর্তমানে চাকমা সমাজব্যবস্থা আধুনিক সমাজব্যবস্থার দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়েছে ।
১৮. খেলাধুলা : চাকমাদের মধ্যে হা-ডু-ডু খেলা, লাটিম খেলা, কুস্তি, রশিটানা, সাঁতার ও দৌড় প্রতিযোগিতা প্রচলিত ছিল। ছেলেদের প্রিয় খেলা ছিল পাটি খেলা, গিলা খেলা প্রভৃতি।
১৯. সংগীতানুষ্ঠান : ঢাকমাদের প্রধান বাদ্যযন্ত্র হলো বাঁশের বাঁশি। পুরুষেরা এ বাঁশিতে প্রেমের গান বাজাত। স্ত্রীলোকেরা বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর জন্য একটানা কাঁপা কাঁপা গলায় গান গাইত।
২০. কুসংস্কার : অনেকে মনে করেন চাকমা সমাজে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত আছে। তাদের মধ্যে দৈত্য দানবে বিশ্বাস প্রচলিত আছে।
২১. আসবাবপত্র : চাকমারা বাঁশ ও বেত দিয়ে সুন্দর সুন্দর ঝুড়ি, ফাঁদ, পাখা, বাঁশি তৈরি করে। চাকমা মহিলাদের তৈরি বিভিন্ন কাপড়ের মধ্যে ফুলখাদী ও নানা রঙের ওড়না দেশি ও বিদেশিদের কাছে খুব প্রিয়।
২২. বজ্ৰবয়ন : বয়নকর্ম চাকমা মেয়েদের জন্য একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। তাদের ব্যাপক নকশা সংবলিত কাপড় আলম নামে পরিচিত, যা মিশরের কারুকার্যময় বস্ত্রাদির মত। চাকমারা দেশীয় পদ্ধতিতে সুতা রং করে। তারা বিভিন্ন ধরনের রং তৈরির জন্য গাছের ছাল, শিকড় ব্যবহার করে থাকে। চরকা দিয়ে সুতা কাটার প্রচলন কোনো কোনো স্থানে
বিদ্যমান। রোগমুক্তির জন্য তারা ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাস করে। যা আধুনিক সমাজের সাথে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে এ ধরনের কুসংস্কার কিছুটা দূরীভূত হতে চলেছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন এথনিক গোষ্ঠী বা বর্ণগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। তবে চাকমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য এথনিক গোষ্ঠী থেকে আলাদা। চাকমারা সবচেয়ে অগ্রসর বর্ণগোষ্ঠী এবং এদের অনেকে শিক্ষা লাভের মাধ্যমে শহরের উন্নত পরিবেশে বসবাস করে। তবে অধিকাংশ চাকমা ঐতিহ্যবাহী জীবনযাপন করে।