পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সামরিক আমলাদের ভূমিকা উল্লেখ কর।

অথবা, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সামরিক আমলাদের অবদানগুলো ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : পাকিস্তানের সৃষ্টি থেকেই দেশটি নানাবিধ জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়। অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক কোন্দল, জাতিগত সংঘাত, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিকে অস্থির করে তোলে। রাজনৈতিক অস্থিরতার এই সুযোগে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং বেসামরিক প্রশাসনে নগ্ন হস্তক্ষেপ করতে থাকে। এভাবে পাকিস্তানে সামরিক আমলা ও বেসামরিক আমলাদের মধ্যে গড়ে ওঠে সুস্পষ্ট সম্পর্ক। পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের প্রভাব একটি জটিল ও সমস্যাবহুল প্রক্রিয়া।
পাকিস্তানে সামরিক আমলাদের প্রভাব : পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে প্রথম সামরিক শাসন জারি হয়েছিল। জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সর্বপ্রথম পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে কলুষিত করেন সামরিক বেসামরিক আমলাদের আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে। নিচে পাকিস্তানে সামরিক আমলাদের প্রভাব বর্ণনা করা হলো :
পাকিস্তানে সামরিক আমলাদের প্রভাব : ১৯৫৮ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল মোহম্মদ আইয়ুব খান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। প্রকৃতপক্ষে এ দিন থেকেই আইয়ুব খান রাষ্ট্রীয় নির্দেশকের ভূমিকা অবতীর্ণ হন। তিনি প্রেসিডেন্ট, সেনাপ্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে দেশ চালাতে থাকেন।
আর্থসামাজিক প্রভাব : দেশের সেনাপ্রধান সামরিক শাসনকর্তা এবং প্রদেশের জিওসি (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং) হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্তরা পদাধিকার বলে সংশ্লিষ্ট প্রদেশের শাসনকর্তারূপে নিযুক্ত হন। সামরিক কর্মকর্তাদের পাশাপাশি প্রদেশগুলোর মুখ্য সচিবদের উপ-সামরিক শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তাদের দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলার সহ-সামরিক শাসনকর্তারূপে নিযুক্ত করা হয়। এভাবে সামরিক শাসনামল উদ্ভূত সামরিক
আমলাতন্ত্র দেশের সাধারণ প্রশাসন আর্থসামাজিক জীবনে প্রভাব বিস্তার শুরু করে।
বিচারিক কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার : সামরিক শাসনামলে প্রদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটদের সরাসরি বিচারের জন্য সামরিক আদালত গঠনের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। সামরিক আদেশ বলা হয় ম্যাজিস্ট্রেটরা ১৯৫৪ সালের পাকিস্তান ফৌজি আইনের ৯০ থেকে ১২৬নং বিধির সাথে প্রধান সামরিক শাসনকর্তার নির্দেশিত বিধিতে বর্ণিত
কার্যক্রম অনুসরণ এবং দণ্ড বিধান করবেন। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানে ১৫টি সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত গঠিত হয়। এসব আদালতের কার্যবিধি পুনর্বিবেচনা ও স্বাক্ষরের জন্য সহ-সামরিক শাসনকর্তাদের নিকট প্রেরণের নির্দেশ ছিল ।
নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার : ১৯৪৭ সালে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বেসামরিক প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উপর নির্ভর
করতে হলেও পাকিস্তান আমলে সামরিক কর্মকর্তাদের বেসরকারি কর্মকর্তাদের উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হয়নি। কারণ
সামরিক কর্মকর্তাদের অনেকেরই ছিল প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা। সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ বেসামরিক আমলের বহু অন্যায়ের
জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দায়ী করেন। আইয়ুব খান ও সি এস পি কর্মকর্তাদের “উচ্চতর শ্রেণিভুক্ত জাতীয়তাবিহীন ব্যক্তি” বলে আখ্যায়িত করেন। বস্তুত সামরিক কর্মকর্তারা বেসামরিক কর্মকর্তাদের বিশ্বাস করেনি। আইয়ুব খানের বিপ্লবী সরকারের ১২ সদস্যের মন্ত্রিসভায় ৩ জন জেনারেল ছিলেন সেই সাথে ২৭২ জন সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ পদে।
প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার : সামরিক আমলারা বেসামরিক আমলাদের ভালো চোখে দেখতেন না। প্রশাসনে সামরিক আমলাদের প্রভাব বিস্তার করতে সি এস পি কর্মকর্তাদের প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কিছু সংখ্যক বেসামরিক কর্মকর্তাদের পদচ্যুত ও অবসর গ্রহণে বাধ্য করেন। সামরিক শাসনামলে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন করা হয়।
বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম : বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সি এস পি কর্মকর্তাদের একচেটিয়া অধিকার খর্ব করা হয় এবং এ পুলের ৪০% সদস্য অন্যান্য সার্ভিস থেকে বাছাই করার ব্যবস্থা করা হয়।
বিভিন্ন কার্যালয়ের পরিচালক : সামরিক শাসনামলে বিভিন্ন অধিদপ্তর বোর্ড পরিদপ্তরের প্রধান হিসেবে নিযুক্তি পান সামরিক আমলাগণ এবং বেসামরিক আমলাদের প্রভাব হ্রাস করা হয় ব্যাপকভাবে। এর ফলে পাকিস্তানে সামরিক আমলাদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
আইন প্রশাসক : সামরিক আমলারা ছিলেন আইন প্রশাসক। সেনাপ্রধান আইয়ুব খান নিজেই একাধারে দেশের প্রেসিডেন্ট, সেনাপ্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন। যা পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় সামরিক আমলাদের প্রভাব সুদৃঢ় হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা : পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ছিল দুর্বল প্রকৃতির। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদ্যমান ছিল। এতে দেশের আইনশৃঙ্খলা ও জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটায় এবং আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রভাব : পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সিদ্ধান্ত গ্রহণে একচেটিয়া অধিকার ভোগ করতো। বেসামরিক আমলাদের থেকে তারা বেশি দক্ষ বলে মনে করতো।
পরিবর্তন ও সংস্কারে প্রভাব : পাকিস্তান সামরিক আমলারা নিজেদেরকে পরিবর্তন ও সংস্কারের বাহক হিসেবে মনে করতো। ফলে তারা পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
রাজনৈতিক উন্নয়নে প্রভাব : পাকিস্তানের সামরিক আমলারা রাজনৈতিক উন্নয়নে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। পাকিস্তানে শাসনব্যবস্থায় অযোগ্য নেতৃত্ব, রাজনৈতিক কোন্দল প্রভৃতির জন্য সামরিক আমলারা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে দোষারোপ করতো।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানে শাসনব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ থেকে বাংলাদেশের উদ্ভবের পর্যন্ত পাকিস্তান শাসিত হয় সামরিক আমলাদের দ্বারা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে সামরিক আমলাদের আধিপত্য বজায় ছিল । যা পাকিস্তান ভাঙনের৷ জন্য অন্যতম কারণ ছিল।