পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণ যেসব আন্দোলন ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল তা বর্ণনা কর।

অথবা, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক শোষণ নীতি ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালিদের আন্দোলনসমূহ আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের উপর অমানবিক নিপীড়ন শুরু করে। বৈষম্যমূলক নীতির মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল। স্বায়ত্তশাসনের দাবি, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক নীতি অনুসরণ করে। বাঙালিরা তাদের উপর নির্যাতন ও নিপীড়ন কখনো সহজে মেনে নেয়নি। সরকারের এরূপ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালিরা সর্বদা সচেতন ও সক্রিয় ছিল। শাসকগোষ্ঠীর এ বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক নীতির বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলায় প্রথমে প্রতিবাদী আন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা হয়।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনসমূহ : পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণ বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে তোলে যা শেষপর্যন্ত স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিণত হয়। নিচে তা বর্ণনা করা হলো :
১. ভাষা আন্দোলন : পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সর্বপ্রথম বাঙালি সংস্কৃতির উপর আঘাত হানে। বাঙালি ঐক্যের মূল ছিল বাঙালি সংস্কৃতি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির ঐক্য ভাঙতে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে। তারা প্রথমে বাংলা ভাষার উপর আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ৫৬% লোকের ভাষা ছিল বাংলা আর মাত্র ৭.২% লোকের ভাষা ছিল উর্দু। এ উর্দু ভাষাকে বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা গ্রহণ করে পাকিস্তান
সরকার। উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা ঘোষণা করলে শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। পূর্ব বাংলার ছাত্র জনতা একত্রে মাতৃভাষা
বাংলা রক্ষার্থে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তীব্র গণআন্দোলনের ফলে পাকিস্তান সরকার উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। ভাষা আন্দোলন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রথম বিজয়। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত রচিত হয়।
২. ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন : ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় লাভ করে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। নির্বাচনে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণ রায় প্রদান করে।
৩. আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন : আইয়ুব খান ছিল বাঙালি বিদ্বেষী। তিনি সামারিক শাসন জারি করে পূর্ব বাংলার উপর নিপীড়ন ও অত্যাচার বৃদ্ধি করে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ও দলীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করতে থাকে, যার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি প্রতিবাদ শুরু করে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান নিজ ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে মনগড়া
সংবিধান রচনা করেন। এতে তিনি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা হ্রাস করেন। ফলে বাংলার জনগণ এ সংবিধানের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৬২ সালে শিক্ষা রিপোর্টের উপর আন্দোলন শুরু করে পূর্ব বাংলার জনগণ। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে অবৈতনিক শিক্ষা বাতিল, আরবি হরফে বাংলা চালু, শিক্ষার ব্যয় সংকোচন প্রভৃতির
বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।
৪. ছয়দফা আন্দোলন : বাঙালির মুক্তির সনদ ছিল ছয়দফা দাবি। ছয়দফা বাঙালির স্বায়ত্তশাসন ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল। অর্থনৈতিক মুক্তি সহ ছয়দফা ছিল বাঙালির বাঁচার দাবি। শোষণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। স্বাবলম্বী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ
। ছিল ছয়দফায়। ছয়দফা কর্মসূচি প্রচারিত হওয়ার পরপরই পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক
সাড়া পড়ে যায় এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ব্যাপকভাবে এ কর্মসূচি সমর্থন করেন। এ ছয়দফা আন্দোলন পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে। ছয়দফা দাবি দমন করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা বলে অ্যাখ্যা দেওয়া হয়। আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করলে ছাত্রজনতা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৬৬ সালের পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক আন্দোলন ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় তথা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের পিছনে উৎসাহ যুগিয়েছিল ছয়দফা ভিত্তিক স্পৃহা।
৫. আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন : ছয়দফা আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা ছয়দফা কর্মসূচিকে দমন করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানসহ মোট ৩৫ জনকে আসামি করে ১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলা দায়ের করে। আগরতলা মামলা শুরু হওয়ার পর থেকেই পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হতে থাকে। আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে পূর্ব বাংলার
ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও ডাকসুর ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আন্দোলন তীব্র গণআন্দোলনে পরিণত হলে সরকার
নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে গড়ে উঠা ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান ক্ষমতা
ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এটা ছিল বাঙালিদের একটা বিরাট বিজয়।
৬. ১৯৬৯ সালে গণ অভ্যুত্থান : ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলার ছাত্রসমাজ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। ছয় দফার উপর ভিত্তি করে ছাত্রসমাজের ১১ দফা আন্দোলন চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। প্রায় প্রত্যেক দিন হরতাল প্রতিবাদ মিছিল চলতে থাকে। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে বহু ছাত্র নিহত ও আহত হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা ও ১১ দফা ভিত্তিক দাবিতে অনড় থাকেন। তীব্র গণ-অভ্যুত্থানে আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করেন। যা পূর্ব বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি বড় বিজয় ছিল।
৭. ১৯৭০ সালের নির্বাচন : ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্ত্বেও পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। এ হীনচক্রান্তের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ প্রদান করেন এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অধিকার আদায়ে বাঙালি জাতিকে
ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
৮. অসহযোগ আন্দোলন : ১৯৭১ সালে ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। এর পর থেকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণের পর স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত কলকারখানা সব বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষুদ্ধ জনতা পাকবাহিনী ও অফিসারদের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ করতে থাকে। খাজনা, ট্যাক্স আদায় বন্ধ হয়ে যায়। অসহযোগ আন্দোলন সফলভাবে
চলতে থাকে, এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে প্রস্তুতি পর্ব।
৯. মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ও স্বাধীনতা সংগ্রাম : ২৫ মার্চ, ৭১ সালের মধ্যরাতে ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তান বাহিনী। পশ্চিম পাকিস্তানের নরপিশাচরা বাঙালি জাতিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে এ বর্বরোচিত ঘটনার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু বাঙালি জাতি তাতে পিছপা না হয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় মত্ত হয়ে অগ্রসর হয় এবং শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। জন্ম হয় নতুন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার উপর বৈষম্যমূলক ও দমনমূলক নীতি গ্রহণ করেছিল। পূর্ব বাংলার মানুষকে ন্যায়সংগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে যার ফলে পূর্ব বাংলায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলে যা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের রূপ নেয়। জন্ম হয় একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।