অথবা, ন্যায়দর্শন অনুসারে অনুমান কী? ন্যায় অনুমান কত প্রকার ও কী কী? আলোচনা কর।
অথবা, ন্যায় অনুমানের সংজ্ঞা দাও।
অথবা, ন্যায়ানুমানের প্রকারভেদ আলোচনা কর।
অথবা, ন্যায়ানুমান কাকে বলে? এর শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন আস্তিক স্কুলসমূহের মধ্যে বস্তুবাদী দর্শন হিসেবে ন্যায়দর্শন স্বাধীন চিন্তা ও বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি গৌতম। ন্যায়দর্শনের মূলভিত্তি হলো ‘ন্যায়সূত্র’। ন্যায়দর্শন যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং বস্তুর জ্ঞান নিরপেক্ষ স্বাধীন সত্তায় বিশ্বাসী। ন্যায়দর্শনকে নামান্তরে তর্কশাস্ত্র, প্রমাণশাস্ত্র, হেতুবিদ্যা, বাদবিদ্যা এবং আন্বীক্ষিকী বিদ্যা বলা হয়। ন্যায়দর্শনের মূল ও প্রধান উপজীব্য বিষয় হলো জ্ঞানতত্ত্ব। নৈয়ায়িকরা জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনায় বলেছেন প্রমাণ চার প্রকার। যথা- প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দ । নিম্নে অনুমান সম্পর্কে ন্যায় মতবাদ আলোচনা করা হলো-
অনুমান (Inference) : অনুমান শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো জ্ঞানের পশ্চাৎগামী জ্ঞান। ‘অনু’ শব্দের অর্থ ‘পশ্চাৎ’ এবং ‘মান’ শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’। সাধারণ অর্থে অনুমান হলো সেই জ্ঞান যা অন্য জ্ঞানকে অনুসরণ করে। এ প্রসঙ্গে Chatterjee & Datta An Introduction to ল Indian Philosophy’ , “Aunumāna (anu-after, māna – knowledge) literally means a cognition or knowledge which follows some other knowledge.” (Page-180)
যখন কোন জ্ঞাত বিষয়ের উপর নির্ভর করে এবং তার দ্বারা সমর্থিত হয়ে কোন অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা হয় তখন তাকে অনুমিতি বলে । অনুমিতি হলো পরোক্ষ জ্ঞান। কাজেই কোন একটি বিষয়কে প্রত্যক্ষ করে সেই প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে অপর একটি অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করার প্রক্রিয়াকে অনুমান বলে। অনুমান হলো পরোক্ষ জ্ঞান, প্রত্যক্ষ জ্ঞান নয় । সুতরাং অনুমান হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ায় আমরা কোন হেতু বা লিঙ্গ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি।
উদাহরণ : পর্বতটি বহ্নিমান, যেহেতু পর্বতটি ধূমবান এবং যেখানেই ধূম সেখানেই বহ্নি। আলোচ্য উদাহরণে ধূম প্রত্যক্ষ করে তারই মাধ্যমে আর একটি বস্তু বহ্নি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা হয়, যেহেতু সেই বস্তুটিতে হেতু বা লিঙ্গ অবস্থিত এবং হেতু বা লিঙ্গ ও সেই বস্তুটির মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ বর্তমান।
অনুমানের শ্রেণিবিন্যাস : নৈয়ায়িকগণ অনুমানকে বিভিন্ন নীতির ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। অনুমান যে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে তার ভিত্তিতে তারা অনুমানকে তারা দু’ভাগে ভাগ করেছেন। যথা : স্বার্থানুমান এবং পরার্থামান।
স্বার্থানুমান : অনুমানকারীরা নিজের জ্ঞান লাভের জন্য যে অনুমান করে তাই স্বার্থানুমান।
পরার্থানুমান : অপরের কাছে কিছু প্রমাণ করার জন্য যে অনুমান করা হয় তাই পরার্থনুমান। স্বার্থানুমান অনুসারে অনুমানকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করার কোন প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু পরার্থনুমানে অনুমানকে
বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত করার প্রয়োজন পড়ে। তাই নৈয়ায়িকগণ একটি অনুমানকে পাঁচটি অবয়বের সাহায্যে ব্যক্ত করেছেন। পাঁচটি অবয়ব আছে বলে নৈয়ায়িকদের অনুমানকে পঞ্চ অবয়বী ন্যায় বলা হয়। এ অবয়বগুলোর নাম হলো :
১.প্রতিজ্ঞা বা প্রমাণের বিষয়;
২.পর্বত অগ্নিমান (প্রতিজ্ঞা
৩.হেতু বা কারণ;
৪.উদাহরণ;
৫.উপনয় বা উদাহরণের প্রয়োগ;
কারণ পর্বত ধূমবান (হেতু)
যেখানে যেখানে ধূম আছে সেখানে সেখানে অগ্নি আছে।
যেমন- পাকশালা (উদাহরণ)
নিগমন বা সিদ্ধান্ত
হেতু ও সাধ্যের মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধে প্রকৃতি বা স্বরূপের ভিত্তিতে নৈয়ায়িকগণ অনুমানকে তিনভাগে ভাগ করেন। যথা :
১।পূর্ববৎ, ২. শেষবৎ ও ৩. সামান্যতোদৃষ্ট।
পর্বত ধূমবান (উপনয়)
পর্বত অগ্নিমান (নিগমন বা সিদ্ধান্ত)
১. পূর্ববৎ
: যেখানে প্রত্যক্ষ এবং তার থেকে যখন অপ্রত্যক্ষ কার্যের কথা অনুমান করা হয় তখন তাকে পর্ববৎ অনুমান বলে। পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ অনুমান করা হয়। যেমন- আকাশে মেঘ দেখে আমরা অনুমান করি যে বৃষ্টি হবে। এখানে মেঘ হলো কারণ এবং বৃষ্টি হলো কার্য ।
২. শেষবৎ : যেখানে প্রত্যক্ষ এবং তার থেকে যখন অপ্রত্যক্ষ কারণের কথা অনুমান করা হয় তখন তাকে শেষবৎ অনুমান বলে । যেমন— নদীর পরিপূর্ণতা ও স্রোতের প্রখরতা দেখে আমরা অতীত বৃষ্টির অনুমান করি।
৩. সামান্যতোদৃষ্ট : হেতু ও সাধ্যের মধ্যে ব্যাপ্তি সম্পর্ক থাকে কিন্তু কোন কার্যকারণ সম্পর্ক থাকে না তাকে সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান বলে। যেমন- চন্দ্রের গতি অপ্রত্যক্ষ হলেও তা অনুমান করা। হেতু ও সাধ্যের মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত করার বিভিন্ন পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে নৈয়ায়িকগণ অনুমানকে আবার
তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা : ১. কেবলান্বয়ী; ২. কেবল-ব্যতিরেকী ও ৩. অন্বয়ব্যতিরেকী।
১. কেবলাম্বয়ী : কেবলমাত্র অন্বয়ী দৃষ্টান্তের উপর ভিত্তি করে (যেখানে হেতু সেখানে সাধ্য) যখন অনুমান করা হয় তখন তাকে কেবলাম্বয়ী অনুমান বলে। এ ধরনের অনুমানে হেতুর সঙ্গে সাধ্যের কেবল অন্বয়-ব্যাপ্তি থাকে।
২. কেবল-ব্যতিরেকী : কেবলমাত্র ব্যতিরেকী দৃষ্টান্তের উপর ভিত্তি করে (হেতুর অভাবের সঙ্গে সাধ্যের অভাবের ব্যাপ্তি বর্তমান) যখন অনুমান করা হয় তখন তাকে কেবল- ব্যতিরেকী অনুমান বলে। এ ধরনের অনুমানে কেবলমাত্র হেতুর সঙ্গে সাধ্যের কেবল ব্যতিরেকী-ব্যাপ্তি থাকে ।
৩. অন্বয়ব্যতিরেকী : হেতু ও সাধ্যের মধ্যে অন্বয় ও ব্যতিরেকী—এ উভয় প্রকার দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে যখন অনুমান করা হয় তখন তাকে অন্বয়ব্যতিরেকী অনুমান বলে। এ ধরনের অনুমানে হেতুর সঙ্গে সাধ্যের অন্বয় ও ব্যতিরেকী-এ উভয় প্রকার ব্যাপ্তি থাকে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ন্যায়দর্শনের জ্ঞানতত্ত্বে অনুমান সম্পর্কে যে আলোচনা করা হয়েছে তা ভারতীয় দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মূলত ভারতীয় দর্শন যে বিচার বিযুক্ত নয় এবং অতিসূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণের উপর প্রতিষ্ঠিত ন্যায়দর্শনের অনুমান সম্পর্কিত আলোচনায় সে কথাই প্রমাণিত হয়।


