নারীর অধস্তনতা বলতে কী বুঝ? নারীর অধস্তনতার কারণসমূহ আলোচনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সমাজে নারীর অবস্থান নির্ণয় কর।

অথবা,নারীর অধস্তনতা কী? বাংলাদেশে নারীর অধস্তনতার কারণসমূহ নির্ণয় করে তাদের সার্বিক অবস্থান তুলে ধর।
অথবা, নারীর অধস্তনতা কাকে বলে? বাংলাদেশের নারীর অধস্তনতার কারণসমূহ আলোচনা করে নারীর অবস্থান মূল্যায়ন কর।
উত্তরা৷ ভূমিকা : মানবসমাজের অর্ধেক নারী এবং অর্ধেক পুরুষ। নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সুন্দর বিশ্ব গড়ে উঠতে পারে। নারী ও পুরুষের সম্মিলিত চেষ্টায় গড়ে উঠেছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও
বিশ্বসভ্যতা। বিশ্ব সংসারে নারী ও পুরুষের সমান অবদান থাকলেও নারী বঞ্চিত হচ্ছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে । পুরুষ নারীর প্রভু। পুরুষ কর্তা, প্রভু এবং নারী অপর বা Object. পুরুষের অধীনে নারী থাকবে।
নারীর অধস্তনতা : নারীকে মনে করা হয় পুরুষের সেবাদাসী। পুরুষের প্রয়োজনে নারীর সৃষ্টি। নারীর কাজ পুরুষের সেবা করা এবং দাসীর মতো অনুগত থাকা। এঙ্গেলেসের মতে, সম্পত্তিতে ব্যক্তি মালিকানা ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের উপর পুরুষের আধিপত্যের সূচনা। পুরুষদের যৌন স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন থাকে কিন্তু সন্তানের সঠিক উত্তরাধিকার বজায় রাখার জন্য নারীদেরকে এক স্বামীতেই তৃপ্ত থাকতে হয়। অধিকন্তু সম্পত্তির মালিকানা ও উত্তরাধিকার পুরুষের অধিকারে আসায় তাদের প্রতিপত্তি বেড়ে যায়। এ সময় নারী পুরুষের মধ্যে কঠোর শ্রম বিভক্তিরও প্রচলন হয়। এতে উৎপাদনের উপকরণের দখল চলে যায় পুরুষদের হাতে। উৎপাদন ব্যবস্থার থেকে এক রকম বিচ্ছিন্ন করে শুধু সন্তান উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত করা হয়। এঙ্গেলস বলেন, মাতৃতান্ত্রিক সমাজের বিলুপ্তি জাতির সবচেয়ে ঐতিহাসিক পরাজয়। পুরুষরা গৃহস্থালির দখলও ছিনিয়ে নেয়। নারীর মর্যাদার হানি হয়। তারা পুরুষের কামনার দাস ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত হয়। পুরুষেরা নারীদেরকে তাদের অধীনস্থ করে এবং ধীরে ধীরে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সর্বময় ক্ষমতা দখল করে। এর ফলে তারা নিজেদের প্রয়োজন ও স্বার্থ অনুযায়ী নারীদের ব্যবহার করার সুযোগ পায়।
নারীর অধস্তনতার কারণসমূহ : সমাজ বিকাশের বিভিন্ন পর্বে নারীরা পুরুষের অধীন এবং নিম্ন মর্যাদার অধিকারী হয়েছে। নারীর এ অধস্তনতার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। সেগুলো নিম্নরূপ :
১. অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা : সমাজ বিকাশের প্রথম পর্বে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো বৈষম্য ছিল না। আদিম সাম্যবাদী সমাজে নারী ও পুরুষ যৌথভাবে খাবার সংগ্রহ করতো। শিকার জীবনের পরিবর্তে শুরু হয় কৃষি জীবন। কৃষি কাজ শুরু হলে কৃষি উপকরণের মালিক হয়ে যায় পুরুষ। বিবাহ প্রথা চালু হওয়ায় নারীরা গর্ভধারণ ও বাচ্চার লালনপালন করতো। পুরুষরা রোজগার করে আনতো। নারী অর্থনৈতিক উপার্জন থেকে বিচ্যুত হয়। পুরুষ ভরণপোষণের দায়িত্ব
নেয়। নারী অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হারায়। বর্তমান বিশ্বে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে নারী শিক্ষা দীক্ষা গ্রহণ করে বেতনভুক্ত বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। তা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক মূল ক্ষমতা পুরুষের হাতে। অর্থনৈতিকভাবে নারী স্বয়ং সম্পূর্ণ না
হওয়ার কারণে পুরুষের অধীনে নারী রয়েছে।
২. উৎপাদনশীল কাজ হিসেবে গণ্য না করা : নারীর অধস্তনতার অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের কাজকে উৎপাদনশীল কাজ হিসেবে গণ্য না করে শুধু সন্তান উৎপাদনের কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়। আবার সন্তান উৎপাদনকে প্রকৃত কাজের সমমর্যাদা করা হয় না। উৎপাদনশীল কাজকেই শুধু গুরুত্ব দেয়া হয়। কারণ এ দিয়ে অর্থ সম্পদ আয় করা যায়। একজন পুরুষ কৃষি কাজ করে ঘরে ফসল তোলে রা দিন মজুরি খেটে অর্থ আনে। এ কারণে তাকেই পরিবারের রক্ষক এবং
উপার্জনকারী মনে করা হয়। এর ফলে পরিবারে অন্য যারা উপার্জন করে না, তাদের থেকে তার মর্যাদা ও ক্ষমতাও বেশি। নারীরা সাধারণত যে কাজ করে তার জন্য কোনো অর্থকরী মুজরি পায় না। সুতরাং তাদের কাজের উৎপাদনশীল দিকটি অস্বীকৃত।
৩. পুরুষতান্ত্রিক সমাজ : নারী যে সমাজে বসবাস করে এবং বেড়ে উঠে তা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ প্রভু এবং নারী তার দাসী। নারীর কাজ পুরুষের সেবা করা। পুরুষতান্ত্রিক নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে মনে করা হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী বিয়ের পর স্বামীর ঘরে আসে। কিন্তু বিয়ের পর নারীকে চিরচেনা আপন জায়গা ছেড়ে
স্বামীর ভিটেকে আঁকড়ে থাকতে হয়। বিয়ের পর নারী তার পিতামাতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়। ইসলাম ধর্মে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার থাকলেও নারী তা ভোগ করতে পারে না। ফলে নারী স্বামীর প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

  1. নেতিবাচক সামাজিকীকরণ : নারী অধস্তনতার অন্যতম কারণ নারীর নেতিবাচক সামাজিকীকরণ। নারীর কোনো সত্তা বিকাশের জন্য সামাজিকীকরণ হয় না। কন্যাশিশু মায়ের কাছ থেকে প্রথম তার সামাজিকীকরণ শুরু হয়। মায়ের মাধ্যমে সে জানতে পারে সে মেয়ে মানুষ। পুরুষ ছেলে থেকে সে আলাদা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার বিচরণ ক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়ে। নারী যতই শিক্ষিত ও উপার্জনকারী হোক না কেন স্বামীকে তোয়াজ করে চলতে হবে। এভাবে নারীর সামাজিকীকরণের ফলে নারী পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
    ৫. বিবাহ : নারীর অধস্তনতার অন্যতম কারণ বিয়ে। পুরুষতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিয়ে নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ। নারী হিসেবে জন্ম নিলে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতেই হবে। সব ধর্মে নারীর বিয়েকে অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। বিয়ের মাধ্যমে নারী তার স্বাধীনতা হারায়। নারী তার স্বাধীনতা ফিরে পেতে চায় পুত্র সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে। কিন্তু নারীর এ আশা পূর্ণ হয় না। বিয়ের মালা পরিয়ে নারীকে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ করা হয়।
    ৬. শিক্ষাক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা : নারীর অধস্তনতার অন্যতম কারণ শিক্ষা ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা। নারী শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করা হতো। বর্তমানে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। উন্নয়নশীল দেশের নারীরা শিল্প ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। শিক্ষিত মেয়েরা চাকরি করে পরিবারের হাল ধরবে এ আশা পরিবার করে না, মেয়ে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত হোক বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে রান্নার হাড়ি টানতে হয়। অনেক শিক্ষিত মেয়ে বিয়ের পর স্বামী ও সন্তানের জন্য চাকরি করে না। স্বামীর আদেশ নির্দেশ ও স্বামীর সংসারকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে।
    ৭. সমাজে নারীর অবস্থান : বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক অবস্থা খুবই করুণ এবং হতাশাব্যঞ্জক। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেই আমরা দেখি নারী নির্যাতন। যৌতুকের জন্য নারী হত্যা। মেয়েরা ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, ইভটিজিংসহ অন্যান্য সমস্যায় ভোগছে। গ্রাম্য সালিসের মাধ্যমে ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে ১০১ দোররা ও গর্ত করে পাথর মারার ঘটনা এদেশে রয়েছে। নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে একটি উদ্বেগজনিত বিষয় হলো রাষ্ট্রীয় তথা পুলিশি নির্যাতন। অতীতে আইনের রক্ষক পুলিশের হাতেও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও যে বিষয়গুলো সত্য অথচ আমরা বুঝার
    চেষ্টা করি না যে, সত্যিকার অর্থে নারীরা সামাজিকভাবে কতটা পিছিয়ে আছে। বিষয়গুলো নিম্নে দেয়া হলো :
    ১. সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে বৈষম্য।
    ২. পারিবারিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বৈষম্য।
    ৪. শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর অনগ্রসরতা।
    ৩. পতি সেবাই প্রধান কাজ।
    ৫. স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নারীর বৈষম্যগত অবস্থান।
    উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় আমাদের সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর যে অবস্থান তা অত্যন্ত দুঃখজনক। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এই অর্ধেক অংশ নানা সমস্যায় জড়িত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক কুসংস্কার, নিপীড়ন ও বৈষম্যের বেড়াজালে নারীদের সর্বদা অবদমিত করে রাখা হয়েছে। তাদের মেধা ও শ্রমকে দেশ গঠনের কাজে সম্পৃক্ত করা হয়নি। তাই দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নারীর সামাজিক বৈষম্য দূর করে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।