উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশে নারী সমাজ এখনো পুরুষের তুলনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে। কেবল সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনেই নয়, বরং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবনে তারা পুরুষের উপর নির্ভরশীল। নারী নির্যাতন বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত হচ্ছে। পূর্বে নারীর প্রতি নানা ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে নারী কোনো প্রকার আইনগত অধিকার ভোগ করতো না। বর্তমানে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সরকার নারীর আইনগত বিধানাবলিকে স্পষ্টভাবে প্রণয়ন করেছে এবং দ্রুত বিচারের মাধ্যমে অপরাধীর বিচারের ব্যবস্থা করেছে।
বাংলাদেশের নারীদের আইনগত অধিকারগুলো : বাংলাদেশের নারীর আইনগত অধিকারগুলো ৪টি ধর্মকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। নিম্নে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান নারীর আইনগত অধিকারসমূহ তুলে ধরা হলো :
মুসলিম আইনে নারীর অধিকারসমূহ : ইসলামি আইন অনুযায়ী নারীদের কতিপয় অধিকার ও কর্তব্যসমূহ আইনগত মর্যাদা প্রদান করা হয় সেগুলো হলো :
ক. বিবাহ : মুসলিম আইন অনুসারে বিবাহ হচ্ছে চুক্তি বিশেষ। যাতে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ই সুনির্দিষ্ট কতিপয় নিয়মকানুনের সমষ্টি।
খ. ভরণপোষণ : মুসলিম আইনে স্ত্রীর ভরণপোষণের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। স্ত্রীর ভরণপোষণ করতে স্বামী বাধ্য।
গ. বহুবিবাহ : ১৯৬১ সলের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ এর সংশোধনী অনুযায়ী প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
ঘ. বিবাহ-বিচ্ছেদ : মুসলিম আইনে বিবাহ একটি চুক্তি। এ চুক্তি দু’ভাবে ভঙ্গ করা যায়। স্বামী-স্ত্রী মধ্যকার মনোমালিন্য বা অন্য কোনো সংগত কারণে উভয়ের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটবার অধিকার রয়েছে।
ঙ. উত্তরাধিকার : ইসলামি আইনানুসারে একজন নারী সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে একজন পুরুষের অর্ধেক লাভ করে।
হিন্দু আইনে নারীর অধিকারসমূহ : হিন্দু আইনে নারীরা যে সকল অধিকার ভোগ করেন, সেগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো:
ক. বিবাহ : হিন্দু আইনে বিবাহ একটি পবিত্র ধর্মীয় বন্ধন। সকল বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে মূলত ব্রাহ্ম বিবাহই সর্বাধিকপ্রচলিত। তবে নারীদের বিবাহ হচ্ছে নিয়তি।
খ. রেজিস্ট্রেশন : বাংলাদেশে মুসলিম বিবাহ রেজিস্ট্রেশন আইনে নারীর অংশীদারিত্ব থাকলেও; হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য কখনো বিবাহ রেজিস্ট্রেশন আইন প্রণীত হয়নি।
গ. বিবাহ বিচ্ছেদ : হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ প্রচলন নেই।
ঘ. বহুবিবাহ ও বিধবা বিবাহ : হিন্দু আইনানুযায়ী স্বামী বহু বিবাহ করতে পারে, কিন্তু স্ত্রীর জন্য মৃত্যু পর্যন্ত বিয়ে একটাই।
ঙ. উত্তরাধিকার : বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু উত্তরাধিকার আইন খবুই বৈষম্যমূলক। বাংলাদেশে হিন্দু আইন আছে সনাতন পদ্ধতিতে যে আইনের সংস্কার আজ পর্যন্ত হয়নি।
খ্রিস্টান আইনে নারীর অধিকারসমূহ : খ্রিস্টান আইনে নারীর অধিকার নিম্নে বর্ণিত হলো :
ক. বিবাহ : খ্রিস্টান আইনে বিবাহ একটি পবিত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং একটি চুক্তি বিশেষ।
খ. বহুবিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ : খ্রিস্টান আইনে বহু বিবাহ একেবারেই নিষিদ্ধ। এখানে স্ত্রীর বর্তমানে স্বামী বা স্বামীর বর্তমানে স্ত্রী কেউ পুনঃ বিবাহ করতে পারবে না।
গ. ভরণপোষণ : খ্রিস্টান আইনে স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বামীর এবং এটি স্ত্রীর অধিকার।
ঘ. উত্তরাধিকার আইন : ১৯২৫ সালের ‘সাক্সেশন আইন’ এর দ্বারা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ন্ত্রিত হয়।
বৌদ্ধ আইনে নারীর অধিকারসমূহ : নিম্নে বৌদ্ধধর্ম মতে নারীর অধিকার বর্ণিত হলো :
ক. বিবাহ : বৌদ্ধধর্ম মতে বিবাহ হলো পুরুষ ও নারীর মধ্যে একটা ধর্মীয় আচার বা সংস্কার যার ভিত্তিতে উভয়ের বন্ধন সামাজিক স্বীকৃতি পায়।খ. বহু বিবাহ ও বিচ্ছেদ : বৌদ্ধধর্মে বহু বিবাহের কোনো রীতি প্রচলিত নেই। তাছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদেরও কোনো প্রথাগত নিয়ম নেই।
গ. ভরণপোষণ : বৌদ্ধধর্মে স্ত্রীকে স্বামীর ভরণপোষণ দেয়ার কোন প্রথা নেই। তাই দেখা যাচ্ছে বৌদ্ধ নারী ভরণপোষণ পাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত।
ঘ. উত্তরাধিকার : সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হিসেবে একজন বৌদ্ধ নারী চরম বৈষম্যের শিকার।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, নারীর অবস্থানকে প্রান্তিক হিসেবেই মূল্যায়ন করা হয়। আইনে একজন নারীকে পূর্ণ ব্যক্তি বা পূর্ণ নাগরিকের মর্যাদা থেকে দূরে রেখে সমাজে নারীর অধস্তনতাকে আরো বেশি সুদৃঢ় করা হয়। জাতি, বর্ণ, নির্বিশেষে এদেশে যে আইন ও ধর্ম, বর্ণ, নিয়মের ভিত্তিতে প্রচলিত যে ব্যক্তিক আইন প্রচলিত আছে সেগুলোতে নারীর মর্যাদা পুরুষের নিম্নতর। এক্ষেত্রে সংবিধানে নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দেবার বিষয়টি স্বীকার করা হলেও, আইন প্রতিষ্ঠা ও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার হতে বঞ্চিত।