অথবা, ড. জি. সি. দেবের দার্শনিক চিন্তাধারা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশ দর্শনে ড. জি. সি দেবের অবদান আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বিশিষ্ট মানবতাবাদী দার্শনিক ঋষিতুল্য জ্ঞানতাপস ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব বাংলাদেশ দর্শনের মধ্যমণি। ড. জি. সি. দেব ছিলেন মানবপ্রেমিক ও সাধারণ মানুষের বন্ধু। ড. দেব সারাজীবন প্রেম ও অহিংসার অমৃত বাণী প্রচার করেছেন। তিনি দর্শনের সকল শাখায় প্রবেশ করে বিশাল জ্ঞান অর্জন করেন। ড. দেব বলেছেন, “সাধারণ মানুষ কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি বা কিছুসংখ্যক ব্যক্তির সমষ্টি নয়।” অধ্যাপক অরবিন্দু বসু প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের এ পণ্ডিতকে ‘God’s good man’ বলে আখ্যায়িত করেন।
ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের দার্শনিক চিন্তাধারা : ড. দেবের দার্শনিক ভাবনার পরিসর ছিল ব্যাপক ও প্রশস্ত।দর্শনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ড. দেব অত্যন্ত সহজভাবে বিচরণ করেছেন। যুক্তিবিদ্যা, জ্ঞানবিদ্যা, অধিবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র ও ধর্মদর্শনে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। ড. দেব তাঁর জ্ঞানের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে। বিশুদ্ধ দার্শনিক তত্ত্বের বিশদ আলোচনা ছাড়াও তিনি তাঁর চিন্তার ভারকেন্দ্রে রেখেছিলেন সাধারণ মানুষের ও মানবজীবনের মৌল প্রয়োজন। ড. দেব দর্শনকে শুধু বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চা বলে চিহ্নিত করেননি, তাঁর নিকট দর্শন মানেই জীবনদর্শন। তাঁর ভাবনা ছিল মানবকল্যাণ কেন্দ্রিক। তাই ড. দেব বস্তুত সমসাময়িক বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বেরও একজন খ্যাতিমান মানবতাবাদী দার্শনিক বলে সুপরিচিত ছিলেন।
ড. দেবের সমন্বয়ী ভাববাদ : জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে দর্শনের ইতিহাসে দুটি প্রধান ধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এর একটি ভাববাদ, অপরটি বাস্তববাদ। আর এ দুটি ধারার দ্বন্দ্ব অতি সুপ্রাচীনকাল হতে। চলমান জগৎ সত্তার নিরপেক্ষ অস্তিত্বে বিশ্বাসী বস্তুবাদ। এতে সাধারণ মানুষের জরুরি চাহিদার কথা স্বীকৃত। আর ভাববাদের মূলকথা হলো জড় এবং প্রত্যক্ষকে অস্বীকার করা। অর্থাৎ, ভাববাদের কাছে ইহলোকের মূল্য নেই। আর বাস্তববাদীদের কাছে পরলোক মূল্যহীন। আর এ ভাববাদের সাথে বস্তুর, চেতনার সাথে জড়ের তথা ভাববাদের সাথে বাস্তববাদের সমন্বয়সাধনই ছিল তাঁর জীবনদর্শনের মূলসুর। আর সেজন্য তিনি তাঁর দর্শনকে জীবনদর্শন তথা সমন্বয়ী দর্শন বা জীবনবাদ বলে উল্লেখ করেন। ড. দেব বস্তুবাদ ও ভাববাদের সনাতন পদ্ধতির সমালোচনা করেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, মানুষের জন্য সুখী ও সুন্দর জগৎ সৃষ্টি করতে হলে ভাববাদে ডুবে থাকলে চলবে না। ভাববাদের সাথে বস্তুবাদের সমন্বয় করতে হবে এবং দর্শনকে নিয়োজিত করতে হবে সাধারণ মানুষের মাঝে। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের জীবনে দুটো দিক রয়েছে। জাগতিক ও আধ্যাত্মিক। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে নিয়ে মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন হতে পারে না। দুটোর সমন্বয়ের ভিতরেই মানুষের সার্থক জীবন। তাই তিনি ভাববাদের নতুন প্রয়োগে বস্তুবাদের সাথে সমন্বয়ে যে ভাববাদের সৃষ্টি করেছেন তার নাম ‘সমন্বয়ী ভাববাদ’।
প্রেম ও কর্মে সমন্বয় : ড. দেবের মতে, “ভাববাদ ও জড়বাদ উভয়ই একে অপরের পরিপূরক। ভাববাদের রয়েছে প্রেমের অনুভূতি এবং বাস্তববাদের রয়েছে কর্মোদ্যম।” কর্মের সাথে প্রেমের মিলন বয়ে আনে আমাদের বাস্তব কল্যাণ। তাই তিনি ভাববাদের নতুন প্রয়োগে বস্তুবাদের সমন্বয়ে যে ভাববাদ সৃষ্টি করেছেন তার নাম ‘সমস্বয়ী ভাববাদ’। তিনি বলেছেন, মুরগি কেটে দু’ভাগ করে যে অংশ ডিম দেয়, ডিমের আশায় সে অংশগ্রহণ করে বাকি অংশ বর্জন করার মধ্যে যে মৃঢ়তা আছে, জড়বাদ বাদ দিয়ে ভাববাদ গ্রহণ করার মধ্যেও সেই একই মৃঢ়তা রয়েছে। সেজন্যই তিনি পুরো মুরগিটি রাখতে চান। অর্থাৎ, ভাববাদ ও বাস্তববাদের মিল ঘটাতে চান।বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার সমন্বয় : ড. দেব সমস্বয়ী ভাববাদের সমর্থনে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার ভূমিকা বিশদভাবে আলোচনা করেন। তিনি ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধির সমন্বয়সাধন করেন। ইন্দ্রিয় দিয়ে মানুষ তার বাইরের জগৎ ও বুদ্ধি দিয়ে তার ভিতরের জগতের বস্তু ও বিষয়ের জ্ঞান লাভ করে। বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়েই নিশ্চিত জ্ঞান পাওয়া যায় বলে ড. দেব মনে করেন। ড. দেব জগতের সত্যতা স্বীকার করেন, বুদ্ধির যা মূল দাবি। এভাবে তিনি অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি ও স্বজা এ
তিনটির মধ্যে সমন্বয় করতে চেয়েছেন।
ভাববাদ ও প্রগতির সমন্বয় : ড. দেব তাঁর ‘Idealism and Progress’ গ্রন্থে ভাববাদের সাথে প্রগতির সমন্বয় করতে চেয়েছেন। তাঁর মত হলো, অধ্যাত্ম সাধনা ও সিদ্ধির সাথে মানুষ, জাগতিক উন্নতির বস্তুত শেষ পর্যন্ত কোনো আত্মিক বিরোধ নেই। ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ তাঁর জীবনের আদর্শে প্রাপ্য, বাঞ্ছনীয় ও সিদ্ধি হতে পারে।
মধ্যপথ : ড. জি.সি. দেব এ সমস্বয়ী দর্শনের সন্ধান পেয়েছেন ‘মধ্যপথ’ অবলম্বনে। এ মধ্যপথ অবস্থিত প্রাচীন অধ্যাত্মবাদ ও আধুনিক উম বস্তুবাদের মাঝখানে। মধ্যপথেই যে মানুষের সার্বিক কল্যাণ নিহিত তা তিনি বুঝাতে চেয়েছেন অতীত ইতিহাসের আলোকে। যেমন- প্রাচীনকালের গৌতম বুদ্ধ এ মধ্যপথ অবলম্বনেই সন্ধান পেয়েছিলেন নির্বাণের। মধ্যপথের গুরুত্ব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষিত হয়েছে ইসলাম ধর্মে। এখানে বলা হয়েছে যে, সার্থক জীবনের নির্যাস নিহিত দ্বীন ও দুনিয়া, ধর্ম, কর্ম ও সোর জীবনের সামঞ্জস্য বিধানে। ড. দেবের সমস্বয়ী ভাববাদ ও মধ্যপথের ভিত্তিমূলে রয়েছে পরম স্বীকৃতি।
ড. দেশের রাষ্ট্রটিকা: ড. দেবের দর্শনচিন্তা রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রেও বিধৃত ছিল। ড. দেব একজন বাস্তববাদী, সমাজ সচেতন ও একজন মহান মানবদরদি চিস্তাবিদ ছিলেন। সাধারণ মানুষের প্রতি ড. দেবের অসাধারণ মমত্ববোধ ছিল। তাই তিনি বলেছেন, আমার গত জীবনকে যেমন আমি ভুলতে পারি না, তেমরি আমি ভুলতে পারি না সেসব হতভাগ্য মানুষের কথাও। তিনি তাঁর বিভিন্ন লেখায় সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক তথা পূর্ণ মুক্তির জয়গান করেছেন। ড. দেব বর্ণবাদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর মতে, এ জাতীয় চিন্তাধারা মানুষের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করে এবং দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার ও শোষণের পথ প্রশস্ত করে। তিনি বিশ্ব রাষ্ট্রের কথা বলেছেন। বিশ্ব রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সহাবস্থান করবে, তবেই রাজনৈতিক মুক্তি আসলে। তিনি বলেছেন, বিশ্ব রাষ্ট্রই পারে বৃহত্তম মানবসমাজের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য যুক্তি, স্বাস্থ্য উদ্ধার, শিক্ষাবিস্তারসহ সকল প্রয়োজন মিটাতে। তাই বিশ্ব রাষ্ট্রের বিকল্প কিছু নেই। ড. দেব সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিরোধী ছিলেন। উন্ন জাতীয়তাবোধ মানুষের মাঝে ভৌগোলিক সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করে এবং সবল জাতি দুর্বল জাতিকে শোষণ করে। ড. দেনের কাছে রাজনীতি ছিল আদর্শ বাস্তবায়নের একটি শক্তিশালী উপায় মাত্র। উদ্দেশ্য নয়, শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। পাঠ্যসূচিতে যেমন মানুষের বস্তুগত প্রয়োজন কীভাবে মিটানো যায়, সেসব বিষয়াবলি অন্তর্ভুক্ত থাকবে, তেমনি থাকলে মানুষের আত্মিক প্রয়োজন পূরণের যথার্থ ব্যবস্থা। তাই বলা যায়, ড. দেব তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারায় সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত, সর্বহারাদের মুক্তির কথা বলেছেন এবং প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে নতুন সমাজব্যবস্থা তৈরির কথা বলেছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ড. বন্দ চন্দ্র দেবের দর্শনের যতই সমালোচনা থাকুক না কেন, সাধারণ মানুষের ব্যবহারিক জীবনে দর্শনের সুপরিকল্পিত প্রয়োগ তাঁর মতো অন্য কোনো দার্শনিক এত আন্তরিকভাবে
কামনা করেছেন বলে মনে হয় না। কোনো দর্শনই সম্পূর্ণ নয়। তবে ড. দেব দার্শনিক ভাবনাকে যে রূপ দিয়েছেন তা চিত্তাকর্ষক, বুদ্ধিমাহ ও তত্ত্ব আবেগসম্পন্ন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর এ সমস্বয়ী ভাববাদের
সঠিক প্রয়োগ হলে এ বিশ্বে গড়ে উঠবে একটি সুখী, সুন্দর, সমৃদ্ধশালী শোষণমুক্ত বিশ্বসংস্থা।