উত্তর : ভূমিকা : চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়কালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। যেগুলোর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল দারিদ্র্য বিমোচন ও মানব সম্পদ উন্নয়ন। আবার এসব প্রকল্পের মধ্যে চারটি ছিল দারিদ্র্য বিমোচন সাম্প্রদায়িক ভিত্তিক নিবিড় উন্নয়ন কর্মসূচি, এছাড়া এ পরিকল্পনায় চলতি কর্মসূচির সাথে নতুন আরও কিছু কর্মসূচি সংযোজন করা হয়।
→ চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো ঃ
১. জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির হার : পরিকল্পনায় দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। পরিকল্পনার সময়সীমার মধ্যে অভ্যন্তরীণ জাতীয় উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৫ ভাগ ধরা হয়। বিভিন্ন খাতের
হারের অভিক্ষেপ নিম্নরূপ- কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লি উন্নয়ন, ৩.৬০ শতাংশ, শিল্প ৯.১০ শতাংশ, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদ ১৪ শতাংশ, পরিবহন ও যোগাযোগ ৪.৩৯ শতাংশ, ভৌত অবকাঠামো গৃহনির্মাণ ইত্যাদি ৬.১০
শতাংশ, অন্যান্য ৪.৫৪ শতাংশ।
২. দারিদ্র্য বিমোচন ঃ পরিকল্পনায় দারিদ্র্য দূরীকরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে বিভিন্ন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভূমিহীন এবং ক্ষুদ্র কৃষক, গ্রামীণ এবং শহরের অপ্রচলিত জনগোষ্ঠীর লোকেরাই অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি দরিদ্র। এই শ্রেণির লোকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ ভাগ। এদের দারিদ্র্যতা দূর করার পরিকল্পনায় বিভিন্ন খাতের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হবে। এ ছাড়াও জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যতা দূরীকরণে পরিকল্পনার আওতায় বিশেষ ধরনের
প্রকল্প উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। সব শ্রমজীবীকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে- দক্ষ, অদক্ষ এবং আংশিক দক্ষ। এর মাধ্যমে শ্রমজীবী ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উপর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলাফল, বিভিন্ন খাতে সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা কর্মসংস্থাপন ও দারিদ্র্য মোচনের সফলতা পরিমাপ করা হবে।
৩. নিয়োগ বৃদ্ধি ঃ পরিকল্পনা মানব সম্পদের উন্নয়ন এর মাধ্যমে নিয়োগ সৃষ্টির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হবে। দেশের বিভিন্ন খাতে জনশক্তির চাহিদা বৃদ্ধি করে তার সাথে সংগতি রেখে নিয়োগ বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দেয়া হবে। দেশের বিভিন্ন খাতের জনশক্তির চাহিদা বৃদ্ধি করে তার সাথে সংগতি রেখে নিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি জনশক্তি উন্নয়ন
নীতি প্রণয়ন করা হবে। এ ক্ষেত্রে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টিও বিশেষ গুরুত্ব পাবে। বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা
হবে নিম্নরূপ :
৪. স্বনির্ভরতা অর্জন ঃ পূর্বের সব পরিকল্পনার মতই চতুর্থ পরিকল্পনার অর্থনীতির স্বনির্ভরতার উপর গুরুত্ব আরোপ
করা হয়েছে।
৫. সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রবর্তন ঃ পরিকল্পনায় সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে দুটি উদ্দেশ্য অর্জনের চেষ্টা করা হবে।
(ক) বিভিন্ন উপার্জনক্ষম শ্রেণির জন্য প্রয়োজনানুরূপ আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান।
(খ) প্রস্তাবিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা দ্বারা সুবিধাভোগীদের সঞ্চয় বৃদ্ধির জন্য উৎসাহিত করা, যার ফলে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় বৃদ্ধি পাবে।
→ চতুর্থ পরিকল্পনায় গৃহীত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কৌশল ঃ চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অভ্যন্তরীণ
জাতীয় উৎপাদনের শতকরা পাঁচ ভাগ নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করা এবং অর্থনীতির গতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিকল্পনায় গৃহীত কৌশলসমূহের বিস্তৃত অর্থে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে।
(ক) সাধারণ কৌশলসমূহ ঃ নিম্নোক্ত সাধারণ কৌশলগুলো অনুসরণের উপরে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে-
১. খাতভিত্তিক পরিকল্পনার সাথে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও গোষ্ঠীভিত্তিক পরিকল্পনার সমন্বয় ঃ চতুর্থ পরিকল্পনার অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে আপেক্ষিকভাবে
দরিদ্র এবং পশ্চাৎপদ লোকদেরকে পরিকল্পনা প্রক্রিয়ার আওতাধীনে আনার জন্য গ্রুপভিত্তিক প্রকল্পের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তাহলেই দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি দারিদ্র্যতা দূর করা যাবে বলে আশা করা যায়। এই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে ভূমিহীন, কৃষি শ্রমিক, ক্ষুদ্র চাষী, মধ্যবিত্ত
কৃষক, বড় কৃষক, বণিক শ্রেণি, গ্রামীণ অকৃষিজীবী গরীব শ্রেণি, শহরে গরীব শ্রেণি, শহরে ধনিক শ্রেণি ইত্যাদি শ্রেণিতে ভাগ করে গ্রুপভিত্তিক উন্নয়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ভূমিহীন ও ক্ষুদ্রচাষী এবং শহর এলাকার গরীব এবং পশ্চাৎপদ লোকেরা সমগ্র জনসংখ্যার ৫০% হওয়ায় তাদের দারিদ্র্যতা দূরীকরণের জন্য খাতভিত্তিক কর্মসূচি ছাড়াও বিশেষ বিশেষ প্রকল্প নেয়ার কথা বলা হয় ।
২. খাতভিত্তিক পরিকল্পনায় আন্তঃখাতের ভারসাম্য অর্জন ঃ প্রতিটি খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন খাতে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কারণে এদের একযোগে যাতে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায় । তার জন্য গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তাই প্রতিটি খাতে বরাদ্দকৃত সম্পদের কাম্য ব্যবহার করতে হবে।
৩. প্রকৃত প্রবৃদ্ধির সাথে কাঠামোগত সামঞ্জস্য ও সমন্বয় সাধন ঃ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো এবং দারিদ্র্যতা দূরীকরণের লক্ষ্যে আর্থিক খাতে কাঠামোগত সামঞ্জস্য বিধান করা হবে। এতে প্রকৃত প্রবৃদ্ধির সাথে খাত ভিত্তিক প্রবৃদ্ধির সমন্বয় সাধন করা হবে।
৪. আর্থিক, ফিসক্যাল এবং বাণিজ্যিক নীতির কাঠামোগত পরিবর্তন ও বর্তমান কর নীতির বেশ কিছু দুর্বলতা আছে। কারণ এখনও সরকারকে রাজস্বের জন্য মূলত পরোক্ষ করের উপর নির্ভর থাকতে হয়। আবার আর্থিক নীতিরও বেশ কিছু দুর্বলতা আছে। বাণিজ্যিক নীতি দুর্বল। তাই এসব ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তন করা হবে।
৫. উন্নয়ন পরিকল্পনার মূল স্রোত মহিলাদের বর্ধিত অংশগ্রহণ ঃ অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে গোষ্ঠিভিত্তিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নিয়োগ আয়, সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং এমনকি পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে মহিলারা কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এজন্য এ শ্রেণিকে সার্বিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্তির জন্য বিশেষ ধরনের বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হবে।
(খ) সুনির্দিষ্ট কৌশলসমূহ-
১. সরকারি খাতে বিনিয়োগ কর্মসূচি ঃ সরকারি খাতে সম্মিলিতভাবে বিনিয়োগ কর্মসূচি প্রণয়ন করা হবে। তবে কোন অধঃখাতের প্রকল্পের সাথে অপরাপর খাতের প্রকল্পের সমন্বয় করা হবে যাতে আন্তঃখাতের ভারসাম্য লক্ষ্য করা যায়। সমাজের গরীব এবং পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীর লোকেরা যাতে বেশি উপকৃত হয় সেজন্য খাতভিত্তিক প্রকল্পের সাথে গ্রুপভিত্তিক প্রকল্পের সংযোগ রক্ষা করা হবে। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় খাতে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সম্পদ ব্যবহারে আরো দক্ষতা বৃদ্ধি করা হবে।
২. বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কর্মসূচি ঃ চতুর্থ পরিকল্পনায় একটি গতিশীল বেসরকারি খাত গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। যাতে এ খাতে সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা সৃষ্টি হয়।
৩. এন. জিও এর মাধ্যমে সামাজিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ৪ বিগত দুই দশকে বাংলাদেশ এন. জি. ও এর সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি হয়েছে। এসব সংস্থা বেশির ভাগ গ্রামীণ উন্নয়নে নিয়োজিত। এজন্য এদের কাজের সমন্বয়ের মাধ্যমে গ্রামের দারিদ্র্য এবং পশ্চাৎপদ লোকদের অবস্থার উন্নতি সাধনের উপর গুরুত্ব দেয়া হবে।
উপসংহার ঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশে এই পর্যন্ত পাঁচটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়েছে। এসব পরিকল্পনার প্রতিটিতেই দারিদ্র্য দূরীকরণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত বৃদ্ধি করা, মানব সম্পদের উন্নয়নের সুযোগ বৃদ্ধি করে
নিয়োগ বৃদ্ধি করা, স্বনির্ভরতা অর্জন ইত্যাদি ধরনের মৌলিক উদ্দেশ্য
ছিল। চতুর্থ পরিকল্পনায় প্রায় সব পুরনো কথারই পুনরাবৃত্তি করেছে বলা যায় ।