উত্তর ঃ ভূমিকা ঃ বাংলাদেশে এই পর্যন্ত পাঁচটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব পরিকল্পনার প্রতিটিতেই দারিদ্র্য দূরীকরণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত বৃদ্ধি করা, মানব সম্পদ উন্নয়নের সুয়োগ বৃদ্ধি করা, নিয়োগ বৃদ্ধি করা, স্বনির্ভরতা অর্পণ ইত্যাদি ধরনের মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল। চতুর্থ পরিকল্পনার প্রায় সব পুরনো কথারই পুনরাবৃত্তি করেছে বলা যায় ।
→ চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কৌশলসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো ঃ
(ক) সাধারণ কৌশলসমূহ ঃ
১. খাত ভিত্তিক পরিকল্পনার সাথে সামাজিক অর্থনৈতিক ও গোষ্ঠীভিত্তিক পরিকল্পনার সমন্বয় : চতুর্থ পরিকল্পনার অর্থনৈতিক বিভিন্ন খাতে আপেক্ষিকভাবে দরিদ্র এবং পশ্চাৎপদ লোকদেরকে পরিকল্পনার প্রক্রিয়ায় আওতাধীনে আনার জন্য গ্রুপভিত্তিক প্রকল্পের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তাহলেই দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি দারিদ্র্যতা দূর করা যাবে বলে আশা করা যায়।
এই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে কৃষি শ্রমিক, ক্ষুদ্রচাষী, মধ্যবিত্ত কৃষক, বড় কৃষক, ধনিক শ্রেণি গ্রামীণ অকৃষিজীবী গরীব শ্রেণি শহরে গরীব শ্রেণি এবং শহরে ধনিক শ্রেণি ইত্যাদি শ্রেণিতে ভাগ করে গ্রুপ ভিত্তিক উন্নয়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ভূমিহীন ও ক্ষুদ্র চাষী এবং শহর এলাকার গরীব এবং পশ্চাৎপদ লোকেরা সমগ্র
জনসংখ্যা ৫০% হওয়ায় তাদের দারিদ্র্যতা দূরীকরণের জন্য খাত ভিত্তিক কর্মসূচি ছাড়াও বিশেষ বিশেষ প্রকল্প নেওয়ার কথা বলা হয় ।
২. খাতভিত্তিক পরিকল্পনার আন্তঃখাতের ভারসাম্য অর্জন ঃ প্রতিটি খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন খাতে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কারণে এদের একযোগে যাতে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়, তার জন্য গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তাই প্রতিটি খাতে বরাদ্দকৃত সম্পদের কাম্য ব্যবহার করতে হবে।
৩. অর্থনীতির দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ ঃ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মূলধন এবং শ্রমের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন কৌশলের উন্নয়ন, লাগসই এবং আধুনিক কৌশলের ব্যবহার, মানব সম্পদের উন্নয়ন প্রশাসনিক এবং ব্যবস্থপনা দক্ষতা, আন্তঃখাতের সংযুক্তি, অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সুবিধা, বৈদেশিক বাজারের বিস্তৃতি ইত্যাদি ধরনের সহায়ক
উপাদানগুলোর অবদান কম নয়। চতুর্থ পরিকল্পনার অর্থনীতির সার্বিক দক্ষতা মূলধন, শ্রম এবং অপরাধের সহায়ক উপাদানের দক্ষতা বৃদ্ধি করে তা কমপক্ষে ২৫% বাড়ানো হবে। এ উদ্দেশ্য দক্ষতার প্রচারণা, উদ্যোগ এবং এর উপর যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
৪. প্রকৃত প্রবৃদ্ধির সাথে কাঠামোগত সামঞ্জস্য ও সমন্বয় সাধন ঃ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো এবং দারিদ্র্যতা দূরীকরণের লক্ষ্যে আর্থিক খাতে কাঠামোগত সামঞ্জস্য বিধান করা হবে। এতে প্রকৃত প্রবৃদ্ধির খাতভিত্তিক প্রবৃদ্ধির সমন্বয় সাধন করা যাবে।
৫. উন্নয়ন পরিকল্পনার মূল স্রোতে মহিলাদের বর্ধিত অংশগ্রহণ ঃ অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে গোষ্ঠীভিত্তিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নিয়োগ, আয়, সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং এমনকি পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে মহিলার কার্যকরী ভূমিকা পালন করে, এজন্য এ শ্রেণিতে সার্বিক পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্তির জন্য বিশেষ ধরনের বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হবে। তাছাড়া পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে এ ব্যাপারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হবে যাতে উভয় শ্রেণি পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কার্যকরীভাবে অংশ নিতে পারে।
৬. আর্থিক, ফিসক্যাল এবং বাণিজ্যিক নীতির কাঠামোগত পরিবর্তন ঃ বর্তমান কর নীতির বেশ কিছু দুর্বলতা আছে। কারণ এখনও সরকারকে রাজস্বের জন্য মূলত পরোক্ষ করের উপর নির্ভর থাকতে হয়। আবার আর্থিক নীতিরও বেশ কিছু দুর্বলতা আছে। বা
ণিজ্যিক নীতি দুর্বল। তাই এসব ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তন করা হবে। যেমন -ফিসক্যাল নীতি এমনভাবে পরিচালিত করা হবে যাতে দক্ষ খাতে উৎপাদন সঞ্চয় এবং বিনিয়োগে বৃদ্ধির প্ররোচনা সৃষ্টি করতে
পারে। তাছাড়া সামাজিক ন্যায় বিচারের পাশাপাশি সম্পদের স্থানান্তর গরীবদের কাছে হস্তান্তরের জোর প্রচেষ্টা নেয়া হবে। আর্থিক নীতির মূল লক্ষ্য হবে সঞ্চ এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় উৎসাহ সৃষ্টি করা, বাণিজ্যিক নীতির লক্ষ্য হবে বাণিজ্যিক গুণকের মাধ্যমে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা এবং দেশ থেকে সম্পদ পাচার যতটা সম্ভব রোধ করা।
৭. প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন ঃ পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে খাতের ভিত্তিতে বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামোর পুনর্গঠন করা হবে। তাহলেই বিভিন্ন খাতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যমাত্রায় তদারকি ও বাস্তবায়ন সহজ হবে।
(খ) সুনির্দিষ্ট কৌশলসমূহ ঃ
১. সরকারি খাতে বিনিয়োগ কর্মসূচি : সরকারি খাতে সমন্বিতভাবে বিনিয়োগ কর্মসূচি প্রণয়ন করা হবে। তবে কোন অধঃখাতের প্রকল্পের সাথে অপরাপর খাতের প্রকল্পের সমন্বয় করা হবে যাতে আন্তঃখাতের ভারসাম্য লক্ষ্য করা যায়। সমাজের গরীব এবং পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীর লোকেরা যাতে বেশি উপকৃত হয় সে জন্য খাত ভিত্তিক প্রকল্পের
সাথে গ্রুপ ভিত্তিক প্রকল্পের সংযোগ রক্ষা করা হবে। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় খাতে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সম্পদ ব্যবহারে আরো দক্ষতা বৃদ্ধি করা হবে।
২. বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কর্মসূচি : চতুর্থ পরিকল্পনায় একটি গতিশীল বেসরকারি খাত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যাতে এ খাতে সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা সৃষ্টি হয়।
৩. এন.জি.ও এর মাধ্যমে সামাজিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ৪ বিগত দুই দশকে বাংলাদেশ এন. জি. ও এর সংখ্যা যথেষ্ট
বৃদ্ধি হয়েছে। এসব সংস্থা বেশির ভাগ গ্রামীণ উন্নয়নে নিয়োজিত। এজন্য এদের কাজের সমন্বয়ের মাধ্যমে গ্রামের
দারিদ্র্য এবং পশ্চাৎপদ লোকদের অবস্থার উন্নতি সাধনের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়।
৪. স্থানীয় পরিকল্পনা এবং সম্পদ সংগ্রহকরণ ঃ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সাথে সংগতি রেখে বৃহত্তর জনগণের
অংশগ্রহণের ভিত্তিতে স্থানীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং সম্পদ সংগ্রহকরণের উপর চতুর্থ পরিকল্পনায়
গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
৫. মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং নিয়োগ ঃ চতুর্থ পরিকল্পনায় মানব সম্পদের উন্নয়ন এবং তার সুষ্ঠু নিয়োগের লক্ষ্যে দেশের শিক্ষা পদ্ধতি এবং কাঠামোর পরিমাণগত এবং গুণগত পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে, এজন্য একটি পৃথক জনশক্তি পরিকল্পনার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল্যায়ন :
প্রথমত : পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল শতকরা ৫ ভাগ। বাস্তবে তা অর্জিত হয় শতকরা ৪.১৫ ভাগ।
দ্বিতীয়ত ঃ কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৩.৪২% থাকলেও বাস্তবে অর্জিত হয় ০.৮৯ মাত্র।
তৃতীয়তঃ শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা ৯.০২ ছিল বিপরীতে ৭.০৫% অর্জিত হয়। শিল্পখাতের এই অর্জন অনেকটা আশানুরূপ বলা যায়। কারণ আমাদের শিল্পখাতের লক্ষ্যমাত্রা কম কথা নয়।
চতুর্থত ৪ নির্মাণ, পরিবহন ও যোগাযোগ, গৃহায়ন ইত্যাদি খাতে যেসব লক্ষ্যমাত্রা সেগুলি অর্জনের হার উল্লেখযোগ্য ছিল বলা যায় ।
পঞ্চমতঃ সরকারি এবং বেসরকারি খাতে নিয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তা প্রথম ক্ষেত্রে অর্জিত না হলেও দ্বিতীয় ক্ষেত্রে পরোপুরি অর্জিত হয়।
উপসংহার ঃ পরিশেষে বলা যায় যে, চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মোট ব্যয় বরাদ্দ ছিল ৬৭.২৩০ কোটি টাকা যা পরে পরিশোধিত হয়ে ৬২০০০ কোটিতে দাঁড়ায়। এর মধ্যে সমাজকল্যাণ খাতে ব্যয় ধরা হয় ১৩৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে চলতি কর্মসূচির জন্য ৫৩.৭২ কোটি টাকা ধার্য করা
হয়।