গ্রামীণ বাংলাদেশের পরিবার ও জ্ঞাতি সম্পর্কের পরিবর্তনের কারণ ও প্রকৃতি বর্ণনা কর।

গ্রামীণ বাংলাদেশের পরিবার ও জ্ঞাতি সম্পর্কের পরিবর্তনের কারণ ও
প্রকৃতি বর্ণনা কর।
অথবা, গ্রামীণ বাংলাদেশের পরিবার ও জ্ঞাতি সম্পর্কের পরিবর্তনের স্বরূপ বা ধারাসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, গ্রামীণ বাংলাদেশের পরিবার ও জ্ঞাতি সম্পর্কের কারণসমূহ ও প্রকৃতি আলোচনা কর।
অথবা, গ্রামীণ বাংলাদেশের পরিবার ও জ্ঞাতি সম্পর্কের পরিবর্তনের কারণ ও ধারা তোমার নিজের ভাষায় আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : প্রতিটি মানবসমাজে জ্ঞাতি সম্পর্কের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। সমাজজীবনে জ্ঞাতি সম্পর্ক একটি নিয়ন্ত্রিত প্রথা। আদিম সমাজের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো এ জ্ঞাতি সম্পর্ক। এটি বংশানুক্রমিকভাবে মিলিত
মানবসমাজের সামাজিক সম্পর্কের সুনির্দিষ্ট রীতি বা বিবাহ এবং রক্ত সম্পর্ক হতে সৃষ্ট। ইংরেজি ‘Kinship’ এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে রক্তের সম্পর্ক, আত্মীয়তার সম্পর্ক বা জ্ঞাতি সম্পর্ক। প্রকৃতভাবে মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে একে অপরের সাথে মিলেমিশে বাস করতে গিয়ে নানা সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। তাই নৃবিজ্ঞানী ‘Molinowsk’ জ্ঞাতি সম্পর্ককে একধরনের সামাজিক সম্পর্ক বলে অভিহিত করেন। গ্রামীণ বাংলাদেশের পরিবার ও জ্ঞাতি সম্পর্কের পরিবর্তনের কারণ ও প্রকৃতি : “The family may be the oldest and longest surviving of all human institutions.”- Harry Gold. মানবসমাজের প্রাচীনতম এবং ক্ষুদ্রতম একক হলো পরিবার। মানুষ দীর্ঘদিন ধরে পরিবারে বসবাস করছে।
সাধারণভাবে মা-বাবা, ভাইবোন নিয়ে পরিবার গড়ে উঠে। এক সময়ে পরিবারেই মানুষ তার সকল কার্যাদি সম্পাদন করত। মানুষ জ্ঞাতি সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করত। কিন্তু সময়ের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিবার ও জ্ঞাতি সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন দু’টি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। দু’টি বিষয় একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রভাবে গ্রামীণ সমাজে পরিবর্তন সাধিত হয়। এছাড়াও জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসার, মানুষের উন্নত জীবনের প্রত্যাশা, সময়ের চাহিদা ইত্যাদি পূরণ করতে গ্রামীণ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে
পরিবর্তন সাধিত হয় । বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের পরিবর্তনের কারণ ও প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করা হলো :
১. যৌথ পরিবারে ভাঙন : কৃষিভিত্তিক তথা আদিম সমাজের মূল প্রকৃতি হলো যৌথ পরিবার। কেননা কৃষিভিত্তিক সমাজে কৃষি কাজের জন্য অনেক লোকের প্রয়োজন হয়। এ কারণে কৃষি সমাজ তথা গ্রামীণ সমাজে যৌথ পরিবার বেশি
দেখা যায়। বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে দুই দশক পূর্বেও বহুসংখ্যক যৌথ পরিবার ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গঠনের প্রবণতা তীব্রভাবে দেখা দিচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে নগরায়ণ ও শিল্পায়নকে দায়ী করা হয়। শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকায় গ্রামের মানুষ পরিবার পরিজনদের ছেড়ে শহরে নতুন পরিসরে পরিবার গড়ে তোলে। এছাড়াও ব্যক্তিগত মর্যাদার ভিন্নতা, পারিবারিক
কলহ প্রভৃতি বিষয় গ্রামীণ সমাজে যৌথ পরিবারে ভাঙন সৃষ্টি করে।
২. বিবাহ ব্যবস্থার পরিবর্তন : বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে পিতামাতা তাদের পছন্দমতো ছেলেমেয়েদের বিবাহ দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্রপাত্রীর নিজস্ব মতামত থাকে না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ অবস্থার ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। গ্রামীণ ছেলেমেয়েরা তাদের নিজস্ব পছন্দমতো বিবাহ করতে শুরু করেছে।
৩. পরিবার সদস্যদের ভূমিকার পরিবর্তন : বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে পিতার ভূমিকাই প্রধান। নারীকে পুরুষের অধীনস্থ জীবনযাপন করতে হয়। এরূপ সমাজে নারীরয়স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না। বর্তমানে গ্রামীণ বাংলাদেশের নারীরা পরিবারের বাইরে চাকরি করে অর্থোপার্জন করে।
তারা পরিবারের বাইরে চাকরি করতে গিয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠে। ফলে তাদেরকে পুরুষের উপর নির্ভর করে থাকতে হয় না। তাই পরিবারে নারী ও পুরুষের ভূমিকায় বহু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
৪. প্রচলিত নিয়ম প্রথার পরিবর্তন : গ্রামীণ বাংলাদেশে আধুনিকতা তথা নতুনত্বের ছোঁয়া খুব কম লাগে। বহির্বিশ্বের সাথে গ্রামীণ বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই কম। সাম্প্রতিক সময়ে এ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। গ্রামীণ
বাংলাদেশে প্রযুক্তির বিকাশের মধ্য দিয়ে মানুষ বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। এভাবে সমাজে প্রচলিত নিয়ম প্রথার পরিবর্তন সাধিত হয়।
৫. পরিবার ও জ্ঞাতি সম্পর্কের সংহতি বিনষ্ট : গ্রামীণ বাংলাদেশে যৌথ পরিবারসমূহের মধ্যে বিভিন্ন সম্পর্কের
ভিত্তিতে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে। ফলে সামাজিক সংহতি দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা পায়। সাম্প্রতিক সময়ে শহরে কর্মসংস্থানের সুযোগসহ বিভিন্ন কারণে গ্রামীণ বাংলাদেশের যৌথ পরিবারে ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে পরিবার ও জ্ঞাতি সম্পর্কের সংহতি বিনষ্ট হচ্ছে।
৬. সামাজিক মর্যাদা : পারিবারিক ঐতিহ্য গ্রামীণ বাংলাদেশে সামাজিক মর্যাদার ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে। ব্যক্তি সমাজে পারিবারিক মর্যাদার ভিত্তিতে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে শিক্ষার বিস্তার, ব্যবসায় বাণিজ্যের
প্রসারসহ বিভিন্ন কারণে গ্রামীণ বাংলাদেশে সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হয়। মানুষ পারিবারিক মর্যাদার বাইরে অর্জিত মর্যাদা লাভ করে।
৭. অর্থনৈতিক কার্যাবলি : এক সময় গ্রামীণ বাংলাদেশের পরিবারগুলোতে সকল অর্থনৈতিক কার্যাবলি সম্পন্ন হতো। এ প্রসঙ্গে ভারতবর্ষের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামের কথা বলা যায়। গ্রামীণ সম্প্রদায় নিজেরা নিজেদের সকল অর্থনৈতিক
কার্যাবলি সম্পাদন করত। বহির্বিশ্বের সাথে তাদের তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। তারা তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তৈরি করত এবং তারা সেগুলো ভোগ করত। তাই পরিবারকে বলা হতো ‘Unit of Production’. বর্তমানে গ্রামীণ
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক কার্যাবলির ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বর্তমানে খাদ্যদ্রব্য ছাড়া বেশিরভাগ দ্রব্য শিল্পকারখানায় উৎপন্ন হয়। তাছাড়া অফিস, আদালত, শিল্পকারখানা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি মানুষের উপার্জনের
অন্যতম উৎসে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে গ্রামীণ পরিবারকে ‘Unit of Production’ না বলে ‘Consumption Unit
বলা হয়। গ্রামীণ বাংলাদেশের পরিবার বর্তমানে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের সাথে জড়িত থাকলেও তার পরিমাণ খুব বেশি নয়।
৮. শিক্ষা ও ধর্মীয় কার্যাবলি : এক সময় গ্রামীণ পরিবার শিশুদের শিক্ষা ও ধর্মীয় কার্যাবলি সম্পাদন করত। গৃহ শিক্ষক নিয়োগ করে শিশুদের বর্ণ শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হতো। মোটকথা, শিশু সকল ধরনের শিক্ষা পরিবারেই
গ্রহণ করত। বর্তমানে গ্রামীণ বাংলাদেশে এর পরিবর্তন দেখা যায়। শিশুরা স্কুল, মাদ্রাসায় গিয়ে শিক্ষালাভ করে। পরিবারের শিক্ষাদান সম্পর্কিত দায়দায়িত্ব ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে গ্রামীণ পরিবার শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান
করে মাত্র। গ্রামীণ শিশুরা উচ্চশিক্ষার জন্য শহরে চলে আসে।২৫৪
৯. অবসর বিনোদন : এক সময়ে গ্রামীণ বাংলাদেশের পরিবারগুলোতে অবসর বিনোদন কাটানো হতো। পরিবারের সদস্যরা গান, গল্প, পুঁথিপাঠ, ঘরোয়া খেলাধুলা এগুলোতে অংশগ্রহণ করত। বর্তমানে গ্রামীণ পরিক
অবসর বিনোদনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। গ্রামে ক্লাব, সিনেমা হলো প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করে অবসর বিনোদন ব্যবস্থা করা হয়।
১০. নিরাপত্তামূলক কার্য : গ্রামীণ বাংলাদেশে পরিবারগুলো তার সদস্যদের নিরাপত্তার দায়দায়িত্ব গ্রহণ করা বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে পুলিশ ফাঁড়ি, হাসপাতাল, ক্লিনিক প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বর্তমানে গ্রামীণ বাংলাদেশে পরিবার ও জ্ঞাতি সম্প বিভিন্ন পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। গ্রামীণ বাংলাদেশে আধুনিকতার ছোঁয়া বেশিরভাগ পরিবর্তন সাধন করে। আধুনিকত
সংস্পর্শে এসে গ্রামীণ বাংলাদেশ পারিবারিক ও জ্ঞাতি সম্পর্কের ক্ষেত্র ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধন করে। এ পরিবর্তন গ্রামীণ বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে পরিচালিত করে।