অথবা, গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর নির্ভরশীল চলকসমূহের ব্যাখ্যা কর।
অথবা, গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর নির্ভরশীল চলকসমূহের বিবরণ তুলে ধর।
অথবা, গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উপর নির্ভরশীল চলকসমূহের সম্পর্কে যা জান বিস্তারিত লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। বিগত দিনগুলোতে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উপর কিছু কিছু নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা হয়েছে। এসব গবেষণা থেকে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর অনেক উপাদান খুঁজে পাওয়া গেছে। গবেষণার উৎস থেকে জানা যায়, গ্রামীণ সমাজে কতিপয় ধনী ব্যক্তি সকল
ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গ্রামকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
নির্ভরশীল চলক (Dependent variable) : গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর নির্ভরশীল চলকসমূহ নিম্নরূপ :
১. রাষ্ট্রের সাথে যোগসূত্র : গ্রামের কোনো ব্যক্তির যদি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির সাথে সুগভীর সম্পর্ক থাকে, তাহলে অন্যান্য লোক তাকে সম্মান করে এবং মেনে চলে। এ সুযোগে ব্যক্তি অন্যান্য সাধারণ মানুষের উপর ক্ষমতা আরোপ করে থাকে।
২. গ্রাম সরকার ইউনিয়ন পরিষদের নেতৃত্ব : গ্রামীণ মানুষ দেশের প্রশাসনিক ক্ষমতা কাঠামোর প্রাথমিক ধাপ গ্রাম সরকার, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যগণকে বিভিন্ন কারণেই মেনে চলে। এ সদস্যগণ গ্রামের জনগণ দ্বারাই নির্বাচিত এবং তারা যথেষ্ট ক্ষমতাবান।
৩. রাজনৈতিক দলের সাথে যোগসূত্র : বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক গোষ্ঠী গ্রামে দেখা যায়। রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা নিজেদেরকে ক্ষমতাবান বলে প্রচার করে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের সাথে জড়িত তারা সবসময়ই নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে গ্রামের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে।
৪. শহরের সাথে যোগসূত্র : গ্রামের সহজ সরল মানুষ মনে করে যারা শহরে থাকে তারা যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী । এছাড়া শহরের লোকেরা অনেক সময়ই নিরীহ গ্রামবাসীদের মধ্যে নিজেদের ক্ষমতার কথা প্রচার করে।
৫. শিক্ষা : বর্তমানকালে দেখা যায়, গ্রামের শিক্ষিতরা গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে যথেষ্ট প্রভাব রাখে। গ্রামের সাধারণ মানুষ কোনো সৎ পরামর্শের জন্য বা জমি সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখানোর জন্য অনেক সময় শিক্ষিত ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হয় । এভাবে শিক্ষিতরা গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে নিজেদের স্থান করে নেয়।
৬. গ্রামীণ কর্মসংস্থান পরিষদের নেতৃত্ব : যাদের হাতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকে এবং জীবিকানির্বাহের পথের সন্ধান যারা করিয়ে দেয়, গ্রামের মানুষ তাদের কথা মেনে চলে।
৭. আধুনিক প্রযুক্তি : গ্রামে অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করে কৃষিক্ষেত্রে এক ব্যাপক সাড়া জাগিয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এসব ধনী কৃষকরা অনেক ক্ষমতার অধিকারী হয়।
৮. কৃষক দরদি : যদি কোনো দরদি ব্যক্তি কৃষককুলের নানাধিক সমস্যা সমাধানকল্পে এগিয়ে আসে এবং সমস্যাসমূহ সমাধানে সমর্থ হয়, তবে জনগণ তাকে যথেষ্ট ক্ষমতাবান বলে স্বীকার করে নেয়।
৯. পেশি শক্তির ভয় : গ্রামে এমন অনেক মানুষ আছে যারা নিজ পেশি শক্তির বলে অন্যকে নিজের অধীন করে রাখে । মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এসব সন্ত্রাসী শক্তি ও গ্রামীণ সমাজে ক্ষমতা প্রদর্শন করে থাকে।
১০. অর্থঋণ : গ্রামের অধিকাংশ গরিব ও ভূমিহীন তাদের সাংসারিক খরচের জন্য গ্রামীণ মহাজনদের নিকট থেকে ঋণ নেয় । এসব মহাজনগোষ্ঠী গরিব মানুষদেরকে নিজ ক্ষমতার আওতায় রাখে।
১১. সমবায় সমিতি : গ্রামের মানুষ সমবায়ের নেতাদের পরামর্শ মেনে চলে। আর এ সূত্রে নেতারা তাদেরকে নিজ নিজ ক্ষমতার মধ্যে ধরে রাখে ।
১২. চাকরি : গ্রামের কোনো ব্যক্তি পদস্থ চাকরিতে নিযুক্ত থাকলে গ্রামের মানুষ তাকে ভয় করে চলে। কারণ তাদের বিশ
্বাস তাঁর অনেক ক্ষমতা।
১৩. জনগণের সমষ্টিবদ্ধতা : গ্রামের মানুষ যারা একতাবদ্ধ হয়ে বাস করে, তারা নিজেদেরকে বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী মনে করেন। তাই গ্রামীণ সমাজে সমষ্টিবদ্ধতা গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর অন্যতম উপাদান।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, গ্রামীণ ক্ষমতার মূল উৎস হচ্ছে ভূমি। ভূমি মালিকানার উপর নির্ভর করেই গ্রামীণ ক্ষমতা গড়ে উঠে। ঐতিহ্যগতভাবে গ্রাম পর্যায়ে বাংলাদেশে বৃহৎ ভূমি গোষ্ঠী নেতৃত্ব দিয়ে থাকে এবং তারাই গ্রামে ক্ষমতা প্রয়োগ করে আসছে। গ্রামে ক্ষমতার ব্যবহার বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে লক্ষ্য করা যায়, যেমন- গোলযোগ মেটানো, সামাজিক অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, ঋণ বা রিলিফ বণ্টনের মাধ্যমে এবং অন্যান্য গ্রাম উন্নয়নমূলক কাজকর্মে। গ্রামে সম্পদ অসমভাবে বণ্টিত বিদায় ক্ষমাও অসমভাবে বণ্টিত।