অথবা, সংবাদপত্রে নারীকে কীভাবে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা যায়?
অথবা, সংবাদপত্রে নারীর রূপায়ণ কীভাবে হয়? সংবাদপত্রের পাতায় নারীকে অপরূপায়ণ থেকে বের করে আনার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়? বর্ণনা কর।
অথবা, গণমাধ্যমে নারীকে কিরূপে উপস্থাপন করা হয়? গণমাধ্যমে নারীকে কীভাবে
ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা যায়? তোমার সুপারিশ তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সংবাদপত্রে নারীর প্রতিকৃতি কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। এর পিছনে রয়েছে সমাজ ও সংস্কৃতির বৃহত্তর ক্যানভাসটি। সমাজ সংস্কৃতির তৈরি করা মূল্যবোধ ও বাস্তবতার ভিতরেই সংবাদপত্র কাজ করে। সংবাদপত্রের মালিক, সাংবাদিক কিংবা পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গিও গড়ে উঠে নির্দিষ্ট সমাজ বাস্তবতায়। আর সমাজটি যেহেতু পুরুষাধিপত্যের নিগড়ে বাঁধা তাই সমাজের অন্যক্ষেত্রের মতো সংবাদপত্রে নারী লিঙ্গীয় বৈষম্যের শিকার হয়। নারীর অধস্তন অবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য সমাজের প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা যে ভূমিকা রাখে, সংবাদপত্রও তা থেকে মুক্ত নয়। সংবাদপত্রে তাই আসা নারীর দুর্বল, অধস্তন, পুরুষনির্ভর, পুরুষকেন্দ্রিক রূপায়ণ দেখতে পাই ।
সংবাদপত্রের পাতায় নারীর উপস্থাপন : সাধারণভাবে নারীকে যে রূপে সংবাদপত্রে দেখা যায়, তা নিম্নে দেয়া হলো :
১. যৌনতা ও অপরাধের অনুষঙ্গ হিসেবে : সাংবাদিকতার তত্ত্বই সংবাদপত্রে নারীর অপরূপায়ণকে উৎসাহিত করে। যেমন— স্ট্যানলি ওয়াকারের দেয়া খুব পরিচিত একটি সংজ্ঞা অনুসারে, ‘Women, Wampum and Wrongdoing sex, Money, Crime’-ই হলো সংবাদ। যৌনতা, অর্থ, অপরাধ এ তিনটি বিষয়ের সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে খুব সহজেই যুক্ত করে দেয়া যায়। সংবাদপত্রে তাই নারীকে দেখা যায় যৌনতা ও অপরাধের অনুষঙ্গ হিসেবে। তাত্ত্বিকভাবেই বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
২. পণ্য হিসেবে নারী : সংবাদপত্রের উদ্দেশ্য হলো ‘টু সেল এন্ড টু টেল’ । পুঁজিতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সংবাদপত্রও একটি পণ্য। আর নারী সংশ্লিষ্ট যেসব আইটেম বিক্রয়যোগ্য পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়, সেসব আইটেম সহজেই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। নারীনির্যাতনের সংবাদ, অপরাধ বিষয়ক সংবাদ, গসিপ, ফ্যাশন ইত্যাদি সংবাদ পত্রিকায় বেশি বেশি ছাপা হয় এবং নারীকে সেখানে যৌনবিষয়ক ও প্রদর্শনযোগ্য সৌন্দর্যের আধার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
৩. ঘটনার শিকার হিসেবে : সংবাদপত্রে নারী প্রধানত ঘটনার শিকার হিসেবেই উপস্থাপিত হয়ে থাকে। সক্রিয় সংবাদ উপাদান হিসেবে তাকে খুব একটা দেখা যায় না। পত্রিকায় সাধারণত সংবাদ হয়ে উঠে তখনই যখন সে কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হয়।
৪. ধর্ষিতা হিসেবে : ধর্ষণ বিষয়ক এবং অন্যান্য নারীনির্যাতনের সংবাদে ঘটনাটিকে যতটা সম্ভব দৃশ্যায়িত বা চিত্রায়িত করার চেষ্টার মাধ্যমে পুরুষ পাঠকদের যৌনানন্দ দেয়ার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। এসব সংবাদে নারীর পরিচয় পাওয়া গেলেও অপরাধীদের পরিচয় প্রায়ই পাওয়া যায় না। ধর্ষণ সংবাদের শব্দও নির্বাচন করা হয় উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে।
৫. অসহায়, দুর্বল হিসেবে : সংবাদে নারীকে উপস্থাপন করা হয় অসহায়, দুর্বল হিসেবে। সংবাদপত্রে তাই প্রায়ই দেখা যায় ‘নারী ও শিশুসহ … জন নিহত’ এ ধরনের শিরোনাম। নারীকে পুরুষ থেকে বিযুক্ত করে শিশুর সঙ্গে পৃথকভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে তাকে দুর্বল সত্তা হিসেবে হাজির করার ঝোঁকই লক্ষ করা যায়।
৬. অধস্তন হিসেবে : যদিও পত্রপত্রিকায় সাম্প্রতিক কালে নারী বিষয়ক আইটেমের সংখ্যা বাড়ছে তবে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তার অধস্তন মানসিকতাকে জিইয়ে রাখার নানা আইটেম। নারী বিষয়ক পাতাগুলোতে নারীর সমস্যা নিয়ে প্রতিবেদন থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই রান্নাবান্না, ফ্যাশন, শিশু পরিচর্যা, গৃহকর্ম ইত্যাদি বিষয
়ের প্রচুর আইটেম থাকে যেসব আইটেম নারীর অধস্তনতাকেই বলবৎ রাখে সংবাদপত্রে নারীকে কিভাবে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করা যায় সে সম্পর্কে
সুপারিশমালা : নিম্নে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে কিভাবে নারীকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা যায় সে বিষয়ে কতিপয়
সুপারিশ দেয়া হলো। এ সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে সংবাদপত্রে নারীর ইতিবাচক ইমেজ ফুটে উঠবে বলে আশা করা যায় :
১. নারীকে দুর্বলভাবে উপস্থাপনের রীতি পরিহার করা : সংবাদপত্রে নারীকে দুর্বল, পুরুষের অধস্তন, পুরুষনির্ভর, পশ্চাৎপদ ইত্যাদি ইমেজে উপস্থাপন করার রীতি পরিহার করতে হবে। সংবাদ, ফিচার এমনকি বিজ্ঞাপনে তা প্রবলভাবে প্রকাশিত হয় কিনা তা কর্তৃপক্ষকে লক্ষ রাখতে হবে।
২. নারী বিষয়ক সংবাদ আরো বেশি প্রকাশ করা ; সংবাদপত্রে আরো বেশি নারী বিষয়ক সংবাদ, সম্পাদকীয় বা উপসম্পাদকীয় বা চিঠিপত্র প্রকাশ করা প্রয়োজন। কেবল নির্যাতনের শিকার নয়, তার অর্জন, সক্রিয় সংবাদ উপাদান হিসেবে নারীকে স্থান দিতে হবে।
৩. নারী বিষয়ক সংবাদের জন্য বেশি প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠায় স্পেস দেয়া : নারী বিষয়ক বিভিন্ন আইটেমের জন্য প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠায় অধিক স্পেস দেয়া প্রয়োজন। আর ট্রিটমেন্টও হওয়া উচিত ভালো। অর্থাৎ প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠায় উপরের দিকে স্থান দিতে হবে। নারী সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ব্যাখ্যামূলক বা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও ছাপা উচিত। সাধারণ হার্ড নিউজে ঘটনার গভীরে যাওয়া যায় না, যা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সম্ভব।
৪. ধর্ষণ বা নির্যাতনের সচিত্র প্রতিবেদন পরিহার করতে হবে : ধর্ষণ বা অন্যান্য নির্যাতনের সংবাদের সচিত্র বর্ণনার রীতি পরিহার করতে হবে। ধর্ষণ সংবাদে যতটা সম্ভব নির্যাতনকারীর পরিচয় দিতে হবে এবং ঘটনার শিকার নারীর পরিচয় যতটা সম্ভব কম দিতে হবে। চাঞ্চল্য সৃষ্টির জন্য বা কাটতির জন্য পরকীয়া প্রেম, হত্যা ইত্যাদিতে নারীকে কেন্দ্রীয় চরিত্র বানিয়ে খবর পরিবেশ করার রীতি পরিহার করতে হবে।
৫. আত্মনির্ভরশীল নারীর চিত্র তুলে ধরতে হবে : সংবাদ, ছবি বা অন্য আইটেমে নারীর দুর্বল প্রতিকৃতির বদলে নারীর সফল, ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরা প্রয়োজন। অর্ধেক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য তথা সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে সফল ও আত্মনির্ভরশীল নারীর চিত্র বেশি করে তুলে ধরা উচিত।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সংবাদপত্রে নারীর প্রতিফলন ও রূপায়ণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীর উপস্থাপন নেতিবাচক। কিন্তু সংবাদপত্রই পারে নারীকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে কারণ সংবাদপত্র হলো একটি গণমাধ্যম। গণমাধ্যম সমাজে মানুষের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। গণমাধ্যম যা তুলে ধরে ভাই সমাজের মানুষ সত্য বলে মনে করে। তাই সংবাদপত্রগুলো যদি নারীর ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে তাহলে সমাজের মানুষের মনে নারীর ইতিবাচক ইমেজ ফুটে উঠবে। আর সংবাদপত্রগুলো যদি জেন্ডার সংবেদনশীল হয়, তাহলে তা সমাজকে জেন্ডার সংবেদনশীল হতে সাহায্য করবে বলে আশা করা যায়।