অথবা কোন রাষ্ট্রের রাজনীতির উপর সংস্কৃতি কী প্রভাব বিস্তার করে? আলোচনা কর।
অথবা, কোন রাষ্ট্রের রাজনীতির উপর সংস্কৃতির প্রভাব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, কোন রাষ্ট্রের রাজনীতির উপর সংস্কৃতির প্রভাব বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : রাজনীতিক বিষয়ে মূল্যবোধ বা মাত্রাবোধের প্রতীক হিসেবে রাজনীতিক, সংস্কৃতি প্রতিপন্ন হয়। বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থার সদস্যদের এক ধরনের মনোভাব, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি বা প্রবণতার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যক্তিবর্গের এসব আবেগ অনুভূতির সমন্বয়ই রাজনৈতিক সংস্কৃতি হিসেবে পরিচিত । রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি ব্যক্তি মানুষের এসব মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা, অনুভূতি ও প্রবণতার এক সমন্বিত রূপকেই বলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কোনো দেশের মূল রাজনৈতিক মূল্যবোধের প্রতীক হলো এ রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
কৃষ্টি বা সংস্কৃতি : কৃষ্টি বা সংস্কৃতি বলতে কোনো একটি জাতির সদস্যবৃন্দের মধ্যে বিদ্যমান সেসব বিশ্বাস ব্যবস্থার সমষ্টিকে বুঝায়, যা অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকে ঐ সমাজের পার্থক্য নির্ণয় করে। কৃষ্টি বা সংস্কৃতি হলো কোনো জাতির স্বকীয়তা নিরূপণের বিশেষ কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়, যার মধ্যে শিক্ষা বা সভ্যতার অনুভূতি নাও থাকতে পারে। সভ্য বা শিক্ষিত জাতি মাত্রই সংস্কৃতিবান, এ কথার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। পৃথিবীর সমগ্র রাষ্ট্রের সমগ্র জাতি তাদের স্ব-স্ব সংস্কৃতির ধারক। সাধারণ
কৃষ্টি অনেকগুলো বিশ্বাস ব্যবস্থার সমষ্টি, যেগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক কৃষ্টি সর্বাপেক্ষা শীর্ষস্থানীয় ।
রাজনীতির উপর সংস্কৃতির প্রভাব : রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সংস্কৃতি আলোচনায় অবশ্যম্ভাবীরূপে রাজনৈতিক সংস্কৃতির
প্রশ্ন চলে আসে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জনের পর এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ও আগ্রাসন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি স্বাভাবিক বিষয়। সংস্কৃতি বলতে বুঝায় কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধের সর্বমান্যতা। রাষ্ট্র গঠনে এবং সার্বভৌমত্ব সুসংহত করতে এ মূল্যবোধের সর্বমান্যতা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। সংস্কৃতি মানুষের অভ্যাস ও মূল্যবোধ থেকে এমনিতেই জন্ম নেয়, আবার সে
সমাজকেই একটি সংহতিতে আবদ্ধ রাখে।
রাষ্ট্র গঠনে সংস্কৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন সংস্কৃতির জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে একটি বৃহৎ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গঠিত হয়েছে। একইভাবে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন সংস্কৃতির, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র ছিল। বর্তমানে ভারতে বহুভাষার, বহু সংস্কৃতির স্বতন্ত্র, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব
বিদ্যমান। তবে ভিন্ন ভিন্ন অনেক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে দেখা যায়, তাদের সংস্কৃতি অভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর কোরিয়া
ও দক্ষিণ কোরিয়ার কথা উল্লেখ করা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা পৃথিবীর মানুষের মনে পারমাণবিক অস্ত্রের ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। মানুষ নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জীবনের প্রত্যাশিত বিধায় তারা যুদ্ধকে এড়াতে চায়। ‘যুদ্ধ নয় শান্তি’ এটাই সাম্প্রতিক বিশ্বের সমগ্র
জনগোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ স্লোগান। একক সংস্কৃতি অন্য রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতিসহ সব রকমের সংস্কৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার ও ধ্বংসের মাধ্যমে শক্তিশালী রাষ্ট্র নিজের সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করছে এরূপ উদাহরণ বর্তমান বিশ্বে বিরল নয়। এক্ষেত্রে সংস্কৃতি বলতে শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সম্পর্কিত সর্বপ্রকার সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করা যায়। অনেক সময় নিজেদের আজন্মলালিত বিশ্বাস ও অনুভূতিকে বিসর্জন দিয়ে নতুন ভাবধারায় নিজেকে উজ্জীবিত করে তোলে। ফলে ধ্বংস হয় পুরানো ঐতিহ্যবাহী কোনো জাতিসত্তার ।
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ছাড়াও সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণও বর্তমান বিশ্বের সংস্কৃতিতে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা এড়াতে পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন সম্মিলিত জাতিসংঘের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি সমগ্র বিশ্বে সাংস্কৃতিক জোট বা সংমিশ্রণের মত বিষয়ও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এক দেশের সাহিত্য সংস্কৃতি যেমন
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অন্য দেশের সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে অনুপ্রবেশ করছে, তেমনি বিভিন্ন মিডিয়া যন্ত্রের বিকাশ ও প্রসারের জন্য ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। এক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অনুসরণ করছে অন্য দেশ। উন্নত রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে অনুন্নত রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ বেছে নিচ্ছে। এভাবে চলছে এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ঘটনা।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, কোনো দেশের রাজনীতির উপর সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। আগেই বলা হয়েছে সংস্কৃতি একটি জাতির কাছে দর্পণস্বরূপ। আর এর প্রভাবেই কোনো দেশের রাজনীতিবিশিষ্ট হয়ে সবার সামনে উন্মোচিত হয়।