অথবা, কৃষি সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলো
আলোচনা কর।
অথবা, কৃষি সমাজের প্রকৃতি আলোচনা কর।
অথবা, কৃষি সমাজের প্রকৃতি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, কৃষি সমাজের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : কৃষি সমাজের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে আজ থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার বছর আগে। গর্ডন চাইল্ডের মতে, “প্রাচীন মানবসমাজে দু’টি সামাজিক বিপ্লব মানুষের জীবনকে উল্লেখযোগ্যভাবে বদলে দিয়েছিল। এর প্রথমটি হলো উদ্যান চাষ সমাজ প্রতিষ্ঠা আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে কৃষি সমাজের উদ্ভব।” এ কৃষি সমাজের উদ্ভব ঘটে প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যের নদীবিধৌত উর্বর ভূমি অঞ্চলে। তারপর তা এশিয়ায়, উত্তর আফ্রিকা ও আমেরিকাতে ছড়িয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে তা সমগ্র পৃথিবীতে কমবেশি বিস্তার লাভ করে।
কৃষি সমাজের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of agrarian societies) : কৃষি সমাজে সাধারণত নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যাবলি পরিলক্ষিত হয়। যেমন-
১. যাযাবর জীবনের সম্পূর্ণ অবসান (End of nomadic life) : কৃষি সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠার পর মানবজীবনের যাযাবর অবস্থার পুরোপুরি অবস্থান ঘটে। মানুষ একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা সমাজে তার আপন বাসস্থান তৈরি করে নেয়, যাতে তার যাযাবর জীবনযাপনের অবসান হয়।
২. উৎপাদন ব্যবস্থা (Production system): কলাযুক্ত লাঙল ও পশুশ্রমের ব্যবস্থার কৌশল আবিষ্কার কৃষিকাজের উদ্ভব ঘটাতে সাহায্য করে, যার ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। আর উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পেতে থাকে যাতে উদ্বৃত্ত উৎপাদন দেখা দেয়, উৎপাদন ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। প্রযুক্তির মান উন্নয়নের মধ্যদিয়ে উদ্বৃত্ত উৎপাদন আরও
উন্নত প্রযুক্তির দিকে ধাবিত করে।
৩. যুদ্ধবিগ্রহ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব (War fare & conflict of power) : G. E. Lenski বলেছেন, “কৃষি সমাজের যুদ্ধবিগ্রহ ছিল একটা স্থায়ী অবস্থা। এমনকি যখন বাইরের শক্তির সাথে যুদ্ধ থাকত না, তখন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই দ্বন্দ্ব সংঘাত লেগে থাকত। যেসব দেশে প্রাতিষ্ঠানিক রাজতন্ত্র ছিল না, সেসব দেশে (যেমন মুঘল এবং রোমান সাম্রাজ্য) এ
ধরনের সংঘাত লেগেই থাকত।”
৪. নগর জীবনের সূত্রপাত (Emergence of urban life) : কৃষি সমাজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো উদ্বৃত্ত ফসলনির্ভর নগর জীবনের সূত্রপাত। কৃষির উপর ভিত্তি করে এনগর সভ্যতার বিকাশ ঘটে। Social History গ্রন্থে বলা হয়েছে, “In about 4000B. C.,
towards modern industrial society.” this was the beginning of the town life which initiated the trend নগরবাসী অবশ্য গ্রামীণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনকে প্রভাবিত করত। এর কারণ হচ্ছে নগরেই বেশি ক্ষমতা ও সম্পদ পুঞ্জীভূত ছিল। ব্যবসার প্রসার ও শ্রমবিভাগের Division of labour) ফলে কৃষি সমাজ নির্ভর নগর জীবনে নানা পেশাদারের উদ্ভব ঘটে। অফিসিয়াল, ধর্মযাজক, পণ্ডিত, লেখক, ব্যবসায়ী, শিল্পী, সৈনিক, শ্রমিক চাকর ইত্যাদি। আরও ছিল একটা ক্ষুদে অবসর জীবনযাপনকারী শ্রেণি যারা খাজনা, পেনশন, লভ্যাংশ বা রাজনৈতিক অফিসের আয়ের উপর নির্ভর করত। মুদ্রা অর্থনীতির প্রচলনের ফলে পুঁজিগঠন সহজ হয়। মুদ্রা অর্থনীতি সঞ্চয় বিনিয়োগ ও মুনাফার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে অসমতার পথকে আরও সুগম করে। লেখার প্রচলন হওয়ায় স্বল্পসংখ্যক লোক অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন হয় এবং অধিকাংশই নিরক্ষর জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত হয়।
৭. কৃষি সমাজের রাষ্ট্র ব্যবস্থা (State of agrarian society) : কৃষি সমাজব্যবস্থার উদ্ভব ঘটার পর রাষ্ট্র আরও সমৃদ্ধশালী হতে থাকে, সুসংগঠিত হয়। উদ্যান চাষ সমাজের তুলনায় কৃষি সমাজের এলাকা ও জনসংখ্যার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে আরও অনেক বড় ও শক্তিশালী হয়ে উঠে। এ সময়ে রাষ্ট্রের সীমানা যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে বড় হতে থাকে।
(Power and privilege, G. E. Lenski)
৮. শাসক শ্রেণি (The governing class) : রাজা, সম্রাট কেউই একা শাসন কাজ চালান নি। রাজাকে কেন্দ্র করে ছোট ক্ষুদে শাসক শ্রেণি সর্বদাই ছিল। লেন্সকির মতে, “কৃষি যুগে জনসংখ্যার শতকরা দুই ভাগ রাজা বা সম্রা
টের সাথে শাসক শ্রেণির দায়িত্ব পালন করেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর চীনা সমাজে এ সংখ্যা ছিল ১.৩%। এ সময়ে রাশিয়ায় ছিল ১.২৫%। সামরিক অফিসার, রাজকর্মচারী ইত্যাদি মিলে রাজার অধীনে সুবিধাভোগী শাসকশ্রেণী সকল কৃষি সমাজের বৈশিষ্ট্য।”
৯. শাসিত শ্রেণি (The retainer class) : কৃষি সমাজের শাসক এবং শাসক শ্রেণির (শাসন কাজে নিয়োজিত রাজকর্মচারীবৃন্দ) জন্য ছিল একটি ছোট সামারিক অফিসারের দল, কিছু পেশাদার সৈন্য, বাড়ির চাকরবাকর এবং কিছু সঙ্গীসাথী। এরা যদিও আলাদা আলাদা কর্তব্য সম্পাদন করত এবং ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার বিশেষ বৈষয়িক সুযোগ সুবিধা পেত, তথাপি সবাই যেহেতু শাসক ও শাসকশ্রেণীর স্বার্থে তাদেরই সেবামূলক কাজ করত। তাই লেন্সকি এদের একটা সাধারণ নামে অভিহিত করেছেন। আর তা হচ্ছে Retainer class বা অনুচর শ্রেণি। কৃষি সমাজের আরও দু’টি সম্পদশালী শ্রেণি হচ্ছে ব্যবসায়ী (বণিক) এবং ধর্মযাজক শ্রেণি।
১০. কৃষক শ্রেণি (Peasant class) : ইতোমধ্যে উল্লিখিত শ্রেণিগুলো যে শ্রেণির শ্রমের উপর নির্ভরশীল ছিল, তারাই হচ্ছে এ কৃষক শ্রেণি। মধ্যযুগের ইউরোপীয় ভূ-স্বামীদের বাড়িতে তাদের অধীন প্রতি কৃষক পরিবারের একজন সদস্য সপ্তাহে গড়ে তিন দিন বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে বাধ্য ছিল। কৃষকের জীবনযাত্রা ছিল খুবই নিম্নমানের।
অভাবের তাড়নায় ভিটি বাড়ি ছেড়ে অন্যত্রে খাদ্যের সন্ধানেও ছুটেছে।
১১. কারিগর শ্রেণি (The artisan class) : কারিগর শ্রেণি হচ্ছে কৃষি সমাজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য বা স্তর। বলা যায়, “There were enough leisure for some individuals for specialized works or craftsmanship i basketry, pottery, weaving, carving & other pursuits.” (Social History, p. 33) কৃষক শ্রেণির মত ভাগ্য উন্নয়নে এরাও বিদ্রোহ করেছে। তবে খুব কম ক্ষেত্রেই তারা লাভবান হয়েছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, কৃষি সমাজের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনার প্রেক্ষিতে সবশেষে বলা যায়, মেক্সিকো ও চীনের গুটিকয়েক উদ্যান কৃষিমূলক সমাজে যে তিনটি অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল, যেসব কৃষি বা কৃষিমূলক সমাজে ব্যাপকভাবে দেখা দেয়। এসব হলো-লিখিত ভাষার ব্যবহার, স্থায়ী নগর কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা ও সামরিক পেশা। কৃষি সমাজেই প্রযুক্তিগত অগ্রগতি বিশেষভাবে অনুভূত হয়। যদি শাসক শ্রেণি কর্তৃক অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ত দ্রুতগতিতে এবং নিষ্ঠুরভাবে কৃষি গত না হতো, তাহলে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের জন্য উন্নততর আবিষ্কারের প্রণোদনা সৃষ্টি হতে পারত না। বস্তুত কৃষিমূলক সমাজে এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিস্থিতি।