অথবা, কুরআনের চিরন্তনতা সম্পর্কে আশারিয়াদের মতবাদ আলোচনা কর।
অথবা, কুরআনের নিত্যতা সম্পর্কে আশারিয়াদের বক্তব্য বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, কুরআনের নিত্যতা সম্পর্কে আশারিয়ারা কী মতবাদ দেন? ব্যাখ্যা কর।
অথবা, কুরআনের চিরন্তনতা সম্পর্কে আশারিয়াদের মতবাদ বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : প্রচলিত মতবাদ ও মুতাজিলা মতবাদের পরস্পরবিরোধী ধারণাও প্রতিদ্বন্দ্বী দৃষ্টিভঙ্গি মসলিম চিন্তাধারায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। প্রচলিত বিশ্বাস ও প্রাচীন ধারণার মূলভিত্তিকে যখন গভীরভাবে নাড়া দেয়, তখন মধ্যপন্থি ও সহনশিল দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের মাধ্যমে সেগুলোর সমন্বয় সাধন ও সমস্যার সমাধানের জন্য এগিয়ে আসেন আশারিয়া
সম্প্রদায়, মুতাজিলা সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আশারিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এ সম্প্রদায় কুরআন ও হাদিসের সঙ্গে খুবই সম্পর্কযুক্ত।
আশারিয়া সম্প্রদায় : আবুল হাসান আলী বিন ইসমাঈল আল আশারির অনুসারীরা হযরত আলী (রাঃ) এর পক্ষে সালিসি প্রতিনিধিত্বকারী আবু মুসা আল আশারির বংশধর। তিনি বুদ্ধিবাদী মুতাজিলা মত এবং গোঁড়া বা রক্ষণশীল মুসলমানদের মতের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে চেয়েছেন। তিনি সমস্যা সমাধানে বুদ্ধি ও প্রত্যাদেশের প্রতি সমানভাবে গুরুত্ব দেন। তবে তার বিশেষ নীতিটি হলো কোন বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে বুদ্ধির উপর গুরুত্ব না দিয়ে প্রত্যাদেশের উপর গুরুত্ব দেন। তবে যুক্তি হলো বুদ্ধির কাজ প্রত্যাদেশকে সমর্থন ও শক্তিশালী করা। তাই আশারিয়ারা বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েছেন ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ তা ইসলামি বিশ্বাস ও আকাইদার কোন ক্ষতিসাধন না করে। তারা বুদ্ধির সীমা
নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তারা বুদ্ধিকে চূড়ান্ত বলেন না, বুদ্ধি একটি পথ, সে পথে সব সময় সত্যকে পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রত্যাদেশের পথ অনন্ত এবং সে সম্পর্কে আমরা চূড়ান্তভাবে প্রত্যাদেশকে গ্রহণ করব। আশারিয়া চিন্তাবিদগণ মনে করেন যে, ধর্মকে বেদাত অভিনবত্ব হতে রক্ষা করতে হলে কালাম শিক্ষা করতে হবে। আর তাই ধর্ম সমর্থনে কালাম
ব্যবহারের কারণে আশারিয়াদের ‘মুতাকাল্লিমুন’ বলা চলে।
কুরআনের নিত্যতা সম্পর্কে আশারিদের মত : কুরআন সৃষ্ট না নিত্য তা নিয়ে মুসলিম চিন্তাবিদগণ ব্যাপক আলোচনা করেছেন। এ সম্পর্কে মুতাজিলারা কুরআনের নিত্যতাকে অস্বীকার করেন। তাদের যুক্তি ছিল কুরআনের নিত্যতা আল্লাহর একত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিন্তু আশারিয়ারা এ মতকে প্রত্যাখ্যান করেন। তারা বলেছেন, আল্লাহর
নিত্যতার সাথে কুরআনের নিত্যতা স্বীকার করলে তা আল্লাহর একত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। এক্ষেত্রে আশারিয়ারা গোঁড়া সম্প্রদায়ের মুসলমানদের মত পোষণ করেন। অর্থাৎ তারা কুরআনের অনাদিত্য ও অসৃষ্টতার জোর সমর্থন করেন। তারা এ সম্পর্কে কুরআনের আয়াতের উদাহরণ দেন, “এই আদেশ আল্লাহর প্রথম ও শেষ আদেশ।” (৩০ : ৪) অর্থাৎ আল্লাহর বাণী সংবলিত কুরআন অনাদি ও অসৃষ্ট। অন্যত্র প্রশ্ন করা হয়েছে, “এ সৃষ্টি ও আদেশ কি তার নয়।” (৭ : ৫৪) এখানে
আল্লাহ তাঁর আদেশকে তার সৃষ্টকর্ম হতে পৃথক বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আশারিয়ারা এ কথার এ অর্থ প্রকাশ করেন যে, আল্লাহর আদেশ তার সৃষ্ট বস্তুর পর্যায়ভুক্ত নয়। অধিকন্তু আল্লাহর আদেশ স্বরূপতাই তাঁর কথা বা বাণীর মাধ্যমে প্রকাশিত। এ দিক থেকে আল্লাহর কালাম অসৃষ্ট। মুতাজিলাদের আপত্তি এখানে যে, কুরআনের অসৃষ্টতার মত প্রচার করে আশারিয়ারা লোগোস বা Logos এর ধারণার সমর্থন করেছিলেন। আর তা করা শিরক অর্থাৎ তা বহু ঈশ্বরবাদেরই শামিল। মুতাজিলাদের যুক্তি এ ছিল যে, আশারিয়ারা যদি কুরআনের অসৃষ্টতার ধারণার সমর্থনে অটল থাকেন তাহলে আল্লাহর পাশাপাশি কুরআনকেও তারা আল্লাহর সহনিত্য বা Co-eternal বলে মনে করেন। কিন্তু তাদের এ মত
আল্লাহর একত্ববাদের পরিপন্থী। অন্যদিকে
আশারিয়া চিন্তাবিদগণ মুতাজিলাদের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ যুক্তির সাহায্যে প্রতিপাদনের চেষ্টা চালান। সেটি হলো যারা কুরআনকে সৃষ্ট মনে করে এবং এর উপর জোর দেয়, তারা প্রকারান্তয়ে কুরআনকে মহানবীর চিন্তার ফল বলে স্বীকৃতি দেয়। আর এটি ইসলামের বিশ্বাস ও চিন্তাধারা বিরোধী।
আশারিয়া চিন্তাবিদদের মতে, কুরআন সৃষ্ট নয়। অনন্তকাল হতেই কুরআন আল্লাহর সত্তায় ছিল এবং তা পরবর্তীকালে ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (স) এর জন্মের বহু পূর্ব থেকেই প্রথম ফেরেস্তাদের কুরআন শোনানো হয়। পরবর্তীতে জিব্রাইল (আ) এর মাধ্যমে ওহী হিসেবে কুরআনকে মহানবী (স) এর কাছে পাঠানো হয়। মহানবী (স) এর কাছে অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে কুরআনকে সৃষ্ট বলা যায়। কুরআনের অক্ষর, উচ্চারণ ও লিখন পদ্ধতি এসবই সৃষ্ট। কিন্তু কুরআন চিরন্তন অনাদিকাল ধরেই তা ছিল ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, উগ্র বুদ্ধিবাদের শক্তি হ্রাসের ফলে ইসলামে যে রক্ষণশীল মতের উদ্ভব হয়েছিল তার মধ্যে আশারিয়া সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য। তারা কুরআনের নিত্যতাকে অস্বীকার করেন। তাদের মতে, কুরআনের নিত্যতাকে স্বীকার করলে এর দ্বারা সেটি সহনিত্য কোন সত্তায় পরিণত হয় না। সুতরাং আশারিয়াদের মতে,
কুরআন চিরন্তন বা নিত্য।