অথবা, সময়ের বিবর্তনে কী সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে?
অথবা, সংস্কৃতির পরিবর্তনে কোন বিষয়গুলো অনুঘটক হিসেবে কাজ করে, আলোচনা কর।
অথবা, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন কিরূপ সংঘটিত হয় ব্যাখ্যা দাও।
অথবা, সংস্কৃতি কী পরিবর্তনশীল প্রপঞ্চ? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। আর এ সমাজবদ্ধ জীবের অন্যতম বড় পরিচয় হলো তার সংস্কৃতি, যার মাধ্যমে মানুষের জীবনযাপন হয় বৈচিত্র্যময়, সুন্দর এবং মার্জিত। সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। তবে সমাজ, জাতি বা দেশভেদে সংস্কৃতির ধরন, বৈশিষ্ট্যে স্বাতন্ত্র্য পরিলক্ষিত হয়।
সংস্কৃতির পরিবর্তনশীলতা (Variability of culture) : সংস্কৃতি মানুষের অর্জিত বিষয়; এটা সহজাত নয়। সমাজ, দেশ, জাতি বা গোষ্ঠীভেদে সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়। কেননা সব জাতি বা দেশের জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য বা আচার আচরণ এক রকম নয়। প্রতিটি জনগোষ্ঠীই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যধারী । কাজেই গোষ্ঠী বা জাতিভেদে সংস্কৃতি ভিন্ন হবে এটাই
স্বাভাবিক। আবার কালভেদে একই জনগোষ্ঠীর জীবনধারার মাঝে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সেক্ষেত্রে একই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে পরিবর্তন প্রতীয়মান হয়। এক একটি জাতির, গোষ্ঠীর, অঞ্চলের বা ইতিহাসের এক একটি অধ্যায়ের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। একারণে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিতে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন- কোন দেশে মদ খাওয়া সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত এবং ভদ্রতার লক্ষণ, আবার কোন দেশে এটা একেবারেই নিষিদ্ধ। আমাদের এ ভারতীয় উপমহাদেশেই দেখা যায়, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মাঝে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সংস্কৃতি বিদ্যমান। যেমন- কোন জনগোষ্ঠীতে এক বিবাহপ্রথা, আবার কোন কোন জনগোষ্ঠীতে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত আছে। সে যাহোক, সংস্কৃতির যে প্রভেদ বা স্বাতন্ত্র্য কিংবা পরিবর্তনশীলতা এর পিছনে রয়েছে বহুবিধ কারণ ও সমাজের বিভিন্ন উপাদানের প্রভাব। এসব কারণ বা উপাদানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কতিপয় কারণ বা উপাদান সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করা হলো :
১. ঐতিহাসিক উপাদান (Historical element) : অনেক সময় দেখা যায়, মানব সংস্কৃতির কোন কোন প্রলক্ষণের উৎস বিশেষ কোন ঐতিহাসিক ঘটনার মাঝে নিহিত থাকে। একারণে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে সংস্কৃতির বিচার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সমাজব্যবস্থার মধ্যে বহুবিধ প্রথা প্রচলিত থাকে। এগুলো সংস্কৃতির অঙ্গবিশেষ এবং সংস্কৃতির প্রলক্ষণ হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
২. ভৌগোলিক অবস্থান (Geographical element) : পৃথিবীর যে কোন ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যাবলি ভৌগোলিক অবস্থানের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সৃষ্টি হয় বিবিধ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সংস্কৃতির। প্রত্যেকটি সংস্কৃতির রূপরেখা রচিত হয় জলবায়ু, আবহাওয়া, প্রাকৃতিক প্রাকৃতিক উপাদানের মধ্যে বিভিন্নতা বিদ্যমান। আর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যজনিত পার্থক্যের কারণে এক একটি অঞ্চলে সম্পদ ইত্যাদির ভিত্তিতে। যেমন—পৃথিবীর শীতপ্রধান দেশের মানুষদের পোশাক পরিচ্ছদ ও খাওয়াদাওয়া গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষদের থেকে আলাদা।
৩. প্রাধান্য সৃষ্টিকারী সাংস্কৃতিক বিষয়াদি (Dominant cultural themes) : পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের সংস্কৃতিরই একটি মুখ্য বা কেন্দ্রীয় বিষয় থাকে। এ মুখ্য বিষয়টি সংস্কৃতির প্রাধান্য সৃষ্টিকারী বিষয় হিসেবে অভিহিত। যেমন— ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বিষয় হলো সমাজব্যবস্থায় পুরুষের প্রাধান্য। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সংস্কৃতির মুখ্য
বিষয় হলো মার্কসবাদ। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতির কেন্দ্রীয় বিষয় হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ।
৪. জৈব পরিবর্তন (Organismic change) : মানবজীবনে জৈব পরিবর্তন সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয়। এ
পরিবর্ত ঘটে মূলত অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে। আর মানুষের এ জৈব পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও পরিবর্তন সূচিত হয়। ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে তার গোষ্ঠী, প্রতিবেশী এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে তথা
সম্পর্ক ও সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলতে হয়। আর এ প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ অব্যাহত গতিতে ধাবিত হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে একই জনগোষ্ঠীর মাঝে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ স্বাতন্ত্র্য বা পার্থক্য প্রতীয়মান হয়।
৫. ব্যক্তি মানুষের মর্জি (Individual whims) : কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যক্তি মানুষের খামখেয়ালিপনার দ্বারা সাংস্কৃতিক প্রলক্ষণ প্রভাবিত হয়। আবার অনেক সময় কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির অস্বাভাবিক আচরণ বা ব্যবহার কিংবা মর্জিমাফিক চলন সংস্কৃতির বিশেষ কিছু প্রলক্ষণকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে ফেজ টুপির পরিবর্তে জিন্নাহ্ টুপির ব্যাপক ব্যবহারের প্রবণতা। আবার একইভাবে ভারতে গান্ধী টুপির প্রচলন ঘটেছে।
৬. উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন (Change in the mode of production) : উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটলে সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন সূচিত হবে, এ বক্তব্য মার্কসবাদীদের। তাঁদের মতে, উৎপাদন পদ্ধতিই হচ্ছে যে কোন জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির মুখ্য নির্ণায়ক। মার্কসীয় দর্শনের দৃষ্টিতে একটি জনগোষ্ঠীর ন্যায়নীতিবোধ, আইন ব্যবস্থা, প্রথা- প্রকরণ, সাহিত্য, ললিতকলা ইত্যাদি কিরূপ হবে তা স্থিরীকৃত হয় সমকালীন উৎপাদন পদ্ধতির প্রেক্ষিতে। এ দৃষ্টিকোণ
হতে প্রতীয়মান হয়, উৎপাদন পদ্ধতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন সূচিত হলে সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে।
৭. বিভিন্ন আবিষ্কার বা উদ্ভাবন (Discoveries and inventions) : নতুন নতুন আবিষ্কার বা উদ্ভাবন সংস্কৃতির পরিমণ্ডলকে নানাভাবে প্রভাবিত করে থাকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের বিশ্বাস, প্রত্যয়, জ্ঞান, ঐতিহ্য, প্রথা পদ্ধতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক বা মৌলিক পরিবর্তন আনয়ন করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় উন্নত একটি জাতির সাংস্কৃতিক
বৈশিষ্ট্যাবলি এবং তুলনামূলকভাবে অনুন্নত একটি জাতির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যাবলির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, পৃথিবীর প্রত্যেকটি জনগোষ্ঠীরই কিছু
নিজস্বতা রয়েছে। যদিও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মাঝে অভাব বা চাহিদাবোধ রয়েছে। কিন্তু সে অভাব বা চাহিদা পূরণের কৌশল বা উপায় ভিন্ন ভিন্ন অর্থাৎ এক একটি জনগোষ্ঠী এক একভাবে অভাব পূরণের চেষ্টা করে। আর একারণেই তাদের জীবনধারায় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। ফলশ্রুতিতে সংস্কৃতি হয় স্বতন্ত্র প্রকৃতির। আর এ স্বাতন্ত্র্য বাস্তব ও সত্য।