উৎপাদনের উপাদানসমূহের তুলনামূলক গুরুত্ব আলোচনা কর।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

অথবা, উৎপাদনের উপাদানগুলোর আপেক্ষিক বা তুলনামূলক গুরুত্ব আলোচনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: একটি পণ্য তৈরি করতে উপকরণ প্রয়োজন। উপকরণ ছাড়া কোনো পণ্য উত্পাদন করা যায় না তাই বলা যায় যে কোনো পণ্য উৎপাদনে উপকরণের গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উৎপাদনের উপায় – জমি, শ্রম, পুঁজি এবং সংগঠনের আপেক্ষিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করতে পারি। এটি নীচে উপস্থাপন করা হয়েছে:

(ক) সাধারণ আলোচনা; (খ) বিশেষ আলোচনা;

বর্ণনা:

(ক) সাধারণ আলোচনা: সাধারণ আলোচনায় ভূমি, শ্রম, পুঁজি এবং সংগঠনের গুরুত্ব নিম্নরূপ:

  1. প্রাথমিক ও মৌলিক উপাদান হিসেবে জমির গুরুত্ব অপরিসীম: আদিম সভ্যতার যুগে মানুষের কাছে ভূমির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি ছিল। তখন মানুষের জীবিকা ছিল পশু শিকার, মাছ ধরা এবং জমি ছিল তাদের একমাত্র ভরসা। কৃষি, মাছ ধরার ক্ষেত্রেও জমি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আজও খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিল্পের কাঁচামাল ইত্যাদির প্রধান উপকরণ জমি থেকে পাওয়া যায়।
  2. একটি জীবন্ত এবং গতিশীল উপাদান হিসাবে, শ্রমের গুরুত্ব অনেক বেশি: শ্রম ছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদ বা জমির সঠিক ব্যবহার সম্ভব নয়। মূলধনের যথাযথ ব্যবহারেও শ্রমের প্রয়োজন হয়। শ্রমিকরা মূলধনী পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে আরও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করতে পারে এবং নতুন সম্পদ আবিষ্কার করতে পারে। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ কৃষিকাজে জড়িত। আর এই কৃষি খাতে শ্রমের অবদান অত্যন্ত বেশি। আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রম বিভাজনের প্রবর্তন উৎপাদন বৃদ্ধি ও বাজার ব্যবস্থা সম্প্রসারণে শ্রমকে অপরিসীম গুরুত্ব দিয়েছে।
  3. উৎপাদনের একটি উপাদান হিসাবে মূলধনের গুরুত্ব: প্রাকৃতিক সম্পদের দক্ষ ব্যবহার এবং অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরিতে মূলধনের একটি অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। পুঁজি শ্রমের দক্ষতা বাড়ায় এবং উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে। তাছাড়া কৃষির আধুনিকায়ন বা যান্ত্রিকীকরণের জন্য পুঁজির বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। অনুন্নত দেশগুলো পুঁজির অভাবে কৃষি ও শিল্প উভয় ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। আধুনিক যুগে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনে পুঁজির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  4. উৎপাদন উপকরণের সমন্বয় এবং ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে সংগঠনের গুরুত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ: উৎপাদন পরিকল্পনা থেকে শুরু করে পণ্যের বিপণন পর্যন্ত, সংগঠন বিভিন্ন স্তরে সমস্ত দায়িত্ব পালন করে। ন্যূনতম খরচে উৎপাদন চালানোর জন্য উৎপাদন উপকরণ সংগ্রহের কাঙ্খিত অনুপাত নির্ধারণ করা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। তাছাড়া আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও গুরুত্ব বহুগুণ বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে, ঝুঁকিপূর্ণ, জটিল উৎপাদন ব্যবস্থা কার্যকরভাবে এবং দক্ষতার সাথে পরিচালনার সাফল্য সাংগঠনিক দক্ষতার উপর নির্ভর করে।

খ) বিশেষ আলোচনা:

১. শিল্প বিপ্লব পূর্ববর্তী প্রেক্ষাপটঃ শিল্প বিল্পবের পূর্বে সমাজ ব্যবস্থা ছিল মূলত কৃষি ভিত্তিক। সে সময়ে ভূমি ও শ্রমের গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। তখন সুসংগঠিত সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের তেমন উলেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়নি। কৃষিই ছিল তখন একমাত্র চালিকা শক্তি।

২. শিল্প বিল্পব পরবর্তী প্রেক্ষাপট: শিল্প বিপবের সাথে সাথে সমগ্র বিশ্বে বিশেষত ইউরোপ ও আমেরিকাতেমবৃহদায়তন উৎপাদন চালু হয়। কৃষির ক্ষেত্র দখল করে শিল্প। তখন মূলধন নিবিড় উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হয়। এর জন্য মূলধন ও সংগঠনের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পায়। প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও অর্থনৈতিক কাঠামো সৃষ্টিতে মূলধন ও সংগঠন, ভূমির পাশাপাশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

৩. সমাজ ব্যবস্থার আলোকে আদিকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থা পৃথিবীর উৎপাদন ব্যবস্থাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে। যেমন

(i) আদিম সভ্যতা ও সামন্ত যুগঃ আদিম যুগে মানুষের কাছে ভূমির গুরত্ব ছিল সবচেয়ে বেশী। তখন পশু শিকার, পশু পালন, ও মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করা হত বলে ভূমির গুরুত্ব ছিল অধিক। পরবর্তীতে সামন্ত প্রভুদের যুগে শ্রমের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। মানুষ দাস হিসেবে পণ্যের মত ক্রয়-বিক্রয় হত।

(ii) সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা: এই সমাজ ব্যবস্থায় উৎপাদন হয় খামার ভিত্তিক। উৎপাদনের উপকরণের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা স্বীকৃত। শ্রমিক তাদের যোগ্যতা, সামর্থ্য, অভিজ্ঞতা, ও দক্ষতার আলোকে উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে
সে প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র কর্তৃক মজুরি’লাভ করে। অর্থাৎ, সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রমের গুরুত্বই সর্বাধিক।

(ii) পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা: পুজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার নামেই এর গুরুত্ব বহন করে। এই সমাজে পুঁজির গুরুত্ব সর্বাধিক এবং অধিক গ্রহন যোগ্য। এই সমাজে মানুষ্য শ্রম শক্তি নিজেই পণ্যে পরিণত হয়।

(iv) মিশ্র সমাজ ব্যবস্থাঃ মিশ্র সমাজ ব্যবস্থা পুঁজিবাদী ও সমাজ তন্ত্রের গুণগুলোকেই সংরক্ষণ করে। এরূপ সমাজে প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পুঁজি ও শ্রমের সমন্বয় সাধন করা হয় এবং উৎপাদন কৌশল নির্ধাণ করা হয়। নিম্নে চিত্রের সাহায্যে মিশ্র অর্থনীতিতে উৎপাদন কৌশলের নির্বাচন দেখানো হলঃ

চিত্রে, OX অক্ষে (L) শ্রম ও OY অক্ষে মূলধন (k) দেখানো হল। Q. হল সম-উৎপাদন রেখা। চিত্রে A ও B দুইটি বিন্দু দেখানো হল যা ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদন উপকরণ নির্দেশ করছে। A বিন্দুতে R। কৌশলে শ্রম অপেক্ষা মূলধন ব্যবহার অধিক (OK, > OLI)। তাই R) কৌশল মূলধন নিবিড়।

বিন্দুতে পুঁজি অপেক্ষা শ্রমের অধিক ব্যবহার (OK: <OL₂)। তাই R কৌশল শ্রম নিবিড় হিসেবে বিবেচিত। মিশ্র অর্থনীতিতে যে সকল দেশে পুঁজি বেশী তারা R, কৌশল (যেমন আমেরিকা) এবং যে সকল দেশে শ্রম বেশী তারা R₂ কৌশল (যেমন বাংলাদেশ) অনুসরণের মাধ্যমে উৎপাদন পদ্ধতি নির্বাচন করে।

উপসংহার: উৎপাদনের উপাদানের আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ভর করে অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর। কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতিতে মূলধন ও সংগঠনের তুলনায় ভূমি ও শ্রমের আপেক্ষিক গুরুত্ব বেশী। পক্ষান্তরে, শিল্প ভিত্তিক অর্থনীতিতে মূলধন ও সংগঠনের আপেক্ষিক গুরুত্ব বেশী। প্রকৃতপক্ষে উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের শিল্প বা কৃষি ভিত্তিক যে কোন উৎপাদন ব্যবস্থায় ভূমি, শ্রম, মূলধন ও সংগঠন এই চারটি উপাদান যৌথভাবে কাজ করে বলে পৃথকভাবে এদের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। সুতরাং অর্থনৈতিক কাঠামো ভেদে উৎপাদনের উপাদানগুলোর গুরুত্বের মধ্যে কিছুটা তারতম্য পরিলক্ষিত হলেও সার্বিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সব উপাদানই কম-বেশী কৃতিত্বের দাবিদার।