উপজাতির গোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার সচেতনতা বৃদ্ধির কারণসমূহ
আলোচনা কর।
অথবা, উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষা সচেতনতা, বৃদ্ধির কারণসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষা সচেতনতা বৃদ্ধির কারণসমূহ তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সকল সমাজে একটি বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠী আছে যারা নির্যাতিত হলেও চোখ বুজে সহ্য করে, যারা ক্ষুধার্ত হলেও খাদ্যের জন্যে হাত প্রসারিত করে না, যাদের হাহাকার নীরবে নিভৃতে কাঁদে। মূলত এ ধরনের সমস্যার মূলে রয়েছে শিক্ষাহীনতা। এসব সমস্যা দূরীকরণের প্রত্যয়ে ‘সর্বজনীন শিক্ষা চাই’ এ ধরনের শ্লোগান সবার মুখে মুখে
ভেসে উঠে । মূলত Sociology of Education এ ধরনের গোষ্ঠী বা শ্রেণিকে নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার সচেতনতা বৃদ্ধির কারণ : সম্প্রতি উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার
প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। আধুনিক শিক্ষার বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার কথা ভেবে তারা শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। নিম্নে উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার সচেতনতা বৃদ্ধির কারণগুলো উল্লেখ করা হলো :
ক. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশের কতকগুলো সমস্যার মধ্যে জনসংখ্যা সমস্যা অন্যতম। সরকারি পর্যায়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রভাব উপজাতি গোষ্ঠীদের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যে প্রয়োজন শিক্ষা। এভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পথ ধরে তারা শিক্ষা গ্রহণ করেছে।
খ. উৎপাদন কৌশলের পরিবর্তন : উপজাতি গোষ্ঠীদের মধ্যে পাহাড়ি জুম চাষের প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বর্তমানে তারা জুমচাষের অসারতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। জুমচাষ ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে তারা পুরাতন পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। কৃষির আধুনিকীকরণের মাধ্যমে অধিক ফসল উৎপাদন সম্ভব
হচ্ছে। এর জন্যে সার, সেচ, কীটনাশকের প্রয়োজন। এগুলোর ব্যবহার জানতে প্রয়োজন হয় শিক্ষার। ফলে আধুনিক কৃষিপদ্ধতির জ্ঞান লাভ করতে তারা শিক্ষা গ্রহণ করছে।
গ. কর্মসংস্থানের সুযোগ সুবিধা : উপজাতিরা ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য চাষাবাদ ছাড়াও মৎস্য চাষ, হাঁসমুরগি পালন, দুগ্ধ খামার স্থাপন, প্রভৃতির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। এসব কাজের জন্য বিভিন্ন কলাকৌশলগত জ্ঞান অপরিহার্য। এসব কলাকৌশল সম্পর্কে জানার জন্যে প্রয়োজন হয় শিক্ষা। এসব কৌশল আয়ত্ত করার জন্যে তারা শিক্ষা গ্রহণ করছে।
ঘ. উন্নত জীবনযাপনের মাপকাঠি : একটি দেশ বা জাতির উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই সার্বিক উন্নয়নের জন্যে শিক্ষা অপরিহার্য। উন্নত জীবনযাপনের প্রবণতা উপজাতিদের মধ্যে বেড়ে চলেছে, যার ফলে তারা শিক্ষা গ্রহণের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এভাবে তারা শিক্ষা গ্রহণের প্রতি অগ্রসর হচ্ছে।
ঙ. সরকারি উদ্যোগ : সম্প্রতি সরকার উপজাতিদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। উপজাতীয় এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। শিক্ষার উপকরণ বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। ফলে তারা শিক্ষার
প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে।
চ. এনজিও কার্যক্রম : সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও সংস্থা উপজাতিদের শিক্ষার ব্যাপারে এগিয়ে আসছে। এসব সংস্থা উপজাতীয় এলাকায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে উপজাতীয় ছেলেমেয়েরা নামেমাত্র মূল্য বা বিনামূল্য শিক্ষার সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে।
ছ. গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা : উপজাতিদের শিক্ষার প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে গণমাধ্যমসমূহ বিভিন্ন ভূমিকা পালন
করছে। গণমাধ্যমসমূহ যেমন- রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র উপজাতিদের শিক্ষাবিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা
এ লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রচারণা, অনুষ্ঠান, কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এভাবে উপজাতিদের মধ্যে শিক্ষার সচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
জ. শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি : উপজাতিদের বর্তমান সরকার উপজাতিদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে উচ্চ শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতির প্রচলন করেছে। উচ্চ শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ গ্রহণ করার জন্য উপজাতিরা শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। চাকরিতে কোটা পদ্ধতির ন্যায় লোভনীয় সুযোগ সুবিধা থাকায় তারা
শিক্ষা গ্রহণ করছে।
ঝ. নেতৃত্ব পরিবর্তন : পূর্বে উপজাতিদের নেতৃত্বের মাপকাঠি ছিল সম্পদ। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার প্রভাবে এ ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে ধনসম্পদের পরিবর্তে শিক্ষা নেতৃত্বের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। একটি সমাজের নিয়ম শৃঙ্খলা পরিচালিত হতে পারে শিক্ষিত লোকের প্রদর্শিত পথ ধরে। সমাজে নেতৃত্বদান, রাজনীতি প্রভৃতির জন্যে
উপজাতিরা শিক্ষা গ্রহণ করে।
ঞ. সামাজিক ও ব্যবসায় বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি : বাঙালিদের সাথে উপজাতিদের সামাজিক ও ব্যবসায় বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি জাতি অন্য জাতির সাথে ভাষার মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন করে। উপজাতিরা বাঙালিদের সাথে সামাজিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্কের জন্যে বাংলা ভাষা গ্রহণ করছে। তারা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সাথে ভাবের আদান-
প্রদানের জন্যে বাংলাভাষা গ্রহণ করছে। এভাবে তারা বাংলাভাষা গ্রহণের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করছে।
ট. নারী উন্নয়ন : বাংলাদেশের জনগণের অর্ধেকই নারী। নারীর শিক্ষা পুরুষের তুলনায় কম। নারী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হলে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। নারী শিক্ষার ব্যাপারে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। উপজাতি নারীরাও এর বাইরে নয়। নারী নিজের উন্নয়নের জন্য শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে।ঠ. চিত্তবিনোদন : চিত্তবিনোদনের মাধ্যম হলো রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা প্রভৃতি। চিত্তবিনোদনের এসব বিষয়
দেশের মূল ভাষা সংস্কৃতির সাথে জড়িত বিধায় অশিক্ষিত উপজাতি গোষ্ঠী বিনোদনে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তারা বিনোদন উপভোগ করার জন্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বায়নের এই যুগে কেউই এখন আর পিছিয়ে থাকতে চায় না। সকলে সীমাবদ্ধতার গণ্ডি পেরিয়ে উন্মুক্ত হতে চায়। এ ‘য়াস থেকেই এবং সরকারি বেসরকারি নানা রকম উদ্যোগের প্রেক্ষিতে উপজাতি সম্প্রদায় তাদের শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন হয়েছে, যা তাদের আত্মমুক্তির অন্যতম কারণ।