অথবা, আল-কিন্দির দর্শন চিন্তায় গ্রিক প্রভাব এবং তার চিন্তার মৌলিকতা নিরূপণ কর।
অথবা, আল-কিন্দির দর্শন চিন্তায় গ্রিক প্রভাব এবং তাঁর চিন্তার মৌলিকতা বিস্তারিতআলোচনা কর।
অথবা, আল-কিন্দির দর্শন চিন্তার গ্রিক প্রভাব এবং তাঁর মৌলিকতা বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মুসলিম দর্শনে মুতাজিলা সম্প্রদায়ের চিন্তাবিদগণ গ্রিকদর্শনের বুদ্ধিবাদকে ব্যবহার করেছিলেন ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যাবলি সমাধানে। অন্যদিকে, অন্য একটি দল একই পদ্ধতি আরও নিষ্ঠার সাথে ব্যবহার করেছিলেন শুধু ধর্মতাত্ত্বিক নয়, দর্শনের মৌলিক সমস্যার সমাধানে। মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে এ দলটি ‘ফালাসিফা’ নামে পরিচিত।
ইসলাম ধর্মের আওতায় থেকে গ্রিক দর্শনের বুদ্ধিবাদী ঐতিহ্যকে তারা দক্ষতার সাথে প্রয়োগ করেছেন। আর এ চিন্তাধারার অগ্রনায়ক ছিলেন আল-কিন্দি। দর্শন ও বিজ্ঞান অধ্যায়নে আল-কিন্দি ছিলেন আরবীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে আরব দার্শনিক বলা হয়ে থাকে।
আল-কিন্দির উপর গ্রিক প্রভাব : আল-কিন্দির উপর গ্রিকদের চিন্তা ও চেতনার প্রভাব লক্ষণীয়। তার আল্লাহ ও জগৎ সম্পর্কিত মতবাদের মধ্যে নব্য প্লেটোবাদের অনেক চিন্তাধারা পরিলক্ষিত হয়। কিন্দির উপর গ্রিক প্রভাবের অন্যতম কারণ হলো গ্রিক রচনার সংস্পর্শে আসা। স্যার থমাস আরনল্ড তাঁর Liegacy of Islam’ গ্রন্থে বলেছেন, “আরব ভাষাভাষী জনসাধারণ সিরীয় খ্রিস্টান ও হাররানের সংস্কৃতিবান জড়বাদী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত গ্রিক দর্শনকে গ্রহণ করেছিলেন এবং সুযোগমতো পারস্য ও ভারতবর্ষে প্রচলিত কিছু চিন্তাধারার সাথে এর সমন্বয় সাধন করেছিলেন।” এ ধারণার বশীবর্তী হয়ে P. K. Hitti তাঁর ‘Histosy of Arabs’ গ্রন্থে বলেছেন, “আল-কিন্দি ছিলেন সারগ্রাহী যিনি নব্য
প্লেটোবাদ ও এরিস্টটলের মতবাদের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছিলেন।” [দর্শন ও প্রগতি ১৬শ বর্ষ; প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা;
ফলে আমরা দেখতে পাই যে, গ্রিক দর্শনের প্রভাব তার উপর ছিল, তবে এটি তাকে ভাষ্যকার হিসেবে নয়, বরং দার্শনিক হিসেবে পরিণত করেছে। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচিত হলো :
ক. নির্গমন মতবাদ : জগৎ সৃষ্টি সম্পর্কে আল-কিন্দি নির্গমন মতবাদের প্রবর্তন করেন। এ মতাবাদে আমরা তার উপর গ্রিক চিন্তার সুস্পষ্ট প্রভাব দেখতে পাই। তার মতে, জগৎ আল্লাহ হতে বিনির্গত হয়, এটি হয় অসচেতনভাবে। যেমন- সূর্যরশ্মি সূর্য হতে নির্গত হয়, কিন্তু এতে তার যেমন ভূমিকা থাকে না বা সচেতনতা আবশ্যক হয় না তেমনি
জগত্ত আল্লাহ হতে সৃষ্টি হয়েছে। এখানে তার এ চিন্তাধারার সাথে প্লটিনাসের চিন্তাধারার মিল খুঁজে পাই ।
খ. বুদ্ধি সম্পর্কিত মত : বুদ্ধি সম্পর্কিত মত অংশত গ্রিক চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হলেও এ সম্পর্কে তার নিজস্ব চিন্তাধারা আমরা দেখতে পাই। তিনি তার মতবাদের এরিস্টটলের আদর্শকে অনুসরণ করেন। M. M Sarif তার History of Muslim Philosophy গ্রন্থের ৪৩২ পৃষ্ঠার মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেছেন, এরিস্টটল অবশ্য বুদ্ধিবৃত্তির দু’টি
শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। সে টি হলো সুপ্ত বুদ্ধিবৃত্তি ও সক্রিয় বুদ্ধিবৃত্তি। এ্যাফ্রেডিসিয়াসের আলেকজান্ডার
তাঁর De Intellectu গ্রন্থে এ বুদ্ধিবৃত্তিকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেন। সেগুলো হলো বাস্তব, অভ্যাগত ও সক্রিয়। কিন্তু আল-কিন্দি এ শ্রেণীকরণকে বর্জন না করলেও বুদ্ধিবৃত্তিকে চার ভাগে ভাগ করে তার স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার মতে, বুদ্ধি হলো সুপ্ত বা সম্ভাব্য বুদ্ধিবৃত্তি, সক্রিয় বুদ্ধিবৃত্তি, অর্জিত বুদ্ধিবৃত্তি, চালক বুদ্ধিবৃত্তি। এগুলো মানুষের মধ্যেই আছে, অন্য কোন প্রাণীর মধ্যে নেই। ফলে স্বভাবতই আমরা বলতে পারি, বুদ্ধি সম্পর্কিত আল-কিন্দির মতবাদ এরিস্টটলীয় তত্ত্বের উপর অগ্রগতির পরিচায়ক।
গ. বস্তু সম্পর্
কে কিন্নির মত : এ কথার মধ্যে হয়ত কিছু সত্যতা আছে যে, আল-কিন্দি এরিস্টটলের পদার্থবিদ্যা হতে তাঁর Five Essence theory গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু কে তাই বলে এরিস্টটলের বহু গ্রন্থের অনুবাদক কিংবা টিকা ভাষ্য রচনাকারী বলা চলে না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, তিনি নব্য প্লেটোবাদীদের আদলে এরিস্টটলকে গ্রহণ করেছিলেন। আল-কিন্দি এরিস্টটলের তথাকথিত Theology গ্রন্থকে সমসাময়িককালে অন্যান্যদের মত এরিস্টটলের মূল গ্রন্থ বলে ভুল করেছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ছিল নব্য প্লেটোবাদী চিন্তাবিদ প্লটিনাসের Enneads গ্রন্থের শেষ তিন খণ্ডের শব্দান্তর। লক্ষণীয় বিষয় হলো যে, তিনি Neo-platonism উৎসাহের সাথে গ্রহণ করেছিলেন। এর একটি কারণ হতে পারে যে, এটি তার সমন্বয়বাদী চিন্তাকে পরিতৃপ্ত করেছিল। উল্লেখ্য, নব্য প্লেটোবাদ পিথাগোরাস, প্লেটো ও এরিস্টটলের মতবাদের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করে এবং এ সমন্বিত মতবাদকে ধর্মের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে। আল- কিন্দির উদ্দেশ্য ছিল দার্শনিক চিন্তার সাথে ধর্মের সমন্বয় সাধন। ফলে এসব মতবাদ তিনি আরও সম্প্রসারিত করেন যাতে তার দক্ষতা ফুটে উঠেছে।
খ. আল্লাহ ঈশ্বর ও জগতের সম্পর্ক : আমাদের চিন্তার বা জানার ক্ষেত্র প্রসারিত। আমরা তাই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পরমসত্তা সম্পর্কে জানতে চাই। শুধু তাকে জেনেই পরিতৃপ্ত হই না, বরং তার সাথে জগতের সম্পর্ক কিরূপ তাও জানতে চাই। উল্লেখ্য, এরিস্টটল ঈশ্বর ও বস্তুজগতের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কেননা, এরিস্টটল প্রথমত চারটি কারণের কথা বললেও পরবর্তীতে এ চারটি কারণকে দু’টি কারণ তথা বস্তু ও আকৃতিতে রূপান্তর করেন। W.T. Stace তাঁর ‘A.Critical History of Greek Philosophy’ গ্রন্থে বলেছেন, “নির্গমন তত্ত্বের মাধ্যমে সরাসরি ঈশ্বর ও বিশ্বজগতের মাধ্যমে কোন সম্পর্কে স্থাপন করতে পারেন নি।” এজন্যই সম্ভবত তিনি কার্যকরীকরণ ও চূড়ান্ত কারণের মধ্যে সমরূপতা উপলব্ধি করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর মতে, কার্যকরীকরণ হলো উদ্ভূত হওয়ার কারণ এবং চূড়ান্ত কারণ হলো উদ্ভূত হওয়ার পরিসমাপ্তি। উল্লেখ্য, এখানেই ঈশ্বর ও জগতের মধ্যে সম্পর্ক নিরূপণে এরিস্টটলের নির্গমন মতবাদের
ব্যাখ্যার ছেদ পড়ে যায়। অন্যদিকে, আল-কিন্দি বলেছেন, যে, “এ বিশ্বজগৎ আল্লাহ হতে বিনির্গত হয়েছে।” তাই স্বর্গীয় সত্তা বিশ্বজগতের কারণ। এ কর্মকাণ্ড স্বর্গীয় মণ্ডলের মাধ্যমে এ পার্থিব বিশ্বে আগমন করে। এ আধ্যাত্মিক এর মাধ্যম হলো মালাইকা বা ফেরেশতা। মধ্যবর্তী মাধ্যমসমূহের শেষ স্তর এবং বস্তুজগতের মধ্যবর্তী স্তরে অবস্থান করে বিশ্ব আত্মা। মানবাত্মা এ বিশ্ব আত্মা হতে বিনির্গত হয়েছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, আল-কিন্দি মৌলিক চিন্তার অধিকারী, তবে তিনি গ্রিক চিন্তা হতে অনেক কিছু গ্রহণ করেছেন। তবে সেগুলো তিনি অনুধাবন করেছেন নিজের মত করে পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানের অধ্যায়ন এবং গ্রিক ও সিরীয় ভাষা জানার কারণে তিনি তত্ত্বের মূলভাব অনুধাবন করতে সক্ষম হন। তাঁর দর্শনে তাই পাশ্চাত্য তথা গ্রিক দর্শনের প্রভাব সুস্পষ্ট। তবে তাঁর দর্শন ইসলামি ধ্যান-ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। মূলত গ্রিক দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত বলতে এটুকুই বুঝায়।