আমলাতন্ত্রে নিয়ন্ত্রণে উপায়সমূহ আলোচনা কর।

অথবা, কীভাবে আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? আলোচনা কর।
অথবা, আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের উপায় বর্ণনা কর।
অথবা, আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
আমলাতন্ত্র একটি সর্বজনীন ধারণা। বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই এ ধারণা বিদ্যমান। কারণ সরকারি কার্যাবলি সম্প্রসারণের সাথে সাথে সরকারকে বেসামরিক প্রশাসনিক কর্মকর্তার উপর নির্ভর করতে হয়। অন্যথায়, রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি সম্পাদন করা তাদের জন্য দুরূহ ব্যাপার হয়ে পড়ে। এক সময়ে এ আমলাতন্ত্র ছিল মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র, আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তবে ইদানীং এ তন্ত্রের সাথে কিছু কিছু নিন্দাসূচক শব্দ যোগ হয়েছে। তাই এটা জনগণের নিকট আজ বিদ্রূপ বা অসম্মানের পাত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের উপায় : আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য যতই থাকুক না কেন, একে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা সম্ভব। আর এটা নিম্নলিখিত উপায়ে করা যায়। যেমন-
১. প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এস. এস. হাইন্সম্যান (S. S. Hynceman) এর মতে, “Bureaucracy must be responsible and responsive.” তাই আমরা বলতে পারি প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ যদি প্রশাসকের না থাকে, তাহলে কোনক্রমেই আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তাই প্রশাসনকে সদা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। uncontrolled bureaucracy is threat to democracy.” তাহলে দেখা যায়, অনিয়ন্ত্রিত আমলাতন্ত্রের হাত থেকে
২. রাজনৈতিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণ : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর, ঐসম্যান (R. Crossman) এর মতে, “A politically দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে হলে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ যদি শক্তিশালী হয় তাহলে আমলাতন্ত্র কখনই নব্য স্বৈরতন্ত্রে পর্যবসিত হতে পারবে না।
অধ্যাপক লাখি (Prof. Luski) : অধ্যাপক নাকি আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের তিনটি উপায়ের কথা বলেছেন। যেমন-
ক. কোনো সরকারি কর্মচারী আট-দশ বছর চাকরি করার পর যখন বুঝতে পারবেন তিনি উক্ত কাজের জন্য যোগ্য নন বা কেউ বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিতে চাইলে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা উচিত।
খ. কর্মচারীদের মধ্য থেকে বাছাইয়ের মাধ্যমে অন্য বিভাগে লোক নিয়োগ করে।
গ. পেনশনের সময়সীমা ৫৫ বছরের মধ্যে রাখা।
৩. বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ : বিচার বিভাগের সক্রিয় ভূমিকার মাধ্যমে আমলাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যায় তাদের জন্য এমন বিধান রাখা উচিত যার মাধ্যমে তারা কোনো কর্মে দোষী সাব্যস্ত হলে শাস্তি দেওয়া যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের বিধান রয়েছে। যেমন- কানাডা, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি প্রভৃতি।
৪. নাগরিক নিয়ন্ত্রণ : নাগরিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা সম্ভব। যদিও আমলাদের কৃতকর্ম জনগণের শাসনে তুলে ধরা হয় না বা প্রকাশ হওয়ার অবকাশ থাকে না তথাপি তাদের কর্মের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। নাগরিকরা এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পালন করতে পারে। যেমন-
ক. রাষ্ট্রীয় কর্ম সম্বন্ধে প্রত্যেক নাগরিককে সচেতন থাকতে হবে।
খ. প্রয়োজনে নাগরিক কমিটি গঠন করতে হবে।
গ. নীতিবান এবং গতিশীল নাগরিক নেতৃত্বের মাধ্যমে।
ঘ. উপযুক্ত লোক নিয়োগে সহায়তার মাধ্যমে।
৫. আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ : প্রতিটি দেশের আইন বিভাগই সে দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। এ বিভাগ তাদের শক্তি সামর্থ্যের মাধ্যমে আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য কমাতে সক্ষম। তারা সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ ঘটালে আমলারা মানসম্মানের ভয়ে তাদের প্রসারিত হাত সংকুচিত করতে বাধ্য হবে।
৬. আইনসভার মাধ্যমে বিশ্বের প্রতিটি দেশেরই জাতীয় সংসদ বা আইনসভা থাকে। এ আইনসভা ইচ্ছে করলে অনেকাংশে আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেমন-
ক. প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে,
গ. সংশোধনের মাধ্যমে,
ঙ. তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে।
খ. আলোচনার মাধ্যমে,< br>ঘ. বাজেট আলোচনার মাধ্যমে এবং
৭. সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সকল দেশেই সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে আমলাতন্ত্রের ক্ষমতাকে খর্ব করে দেওয়া সম্ভব। আমলারা দুর্নীতি করে সংবিধানে প্রণীত আইনের ফাঁকের সাহায্যে। যদি সংশোধনের মাধ্যমে আইনের সে ফাঁক বন্ধ করে দেওয়া যায়, তাহলে আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্ব অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
৮. রাষ্ট্রপতি কর্তৃক : যে কোনো দেশের রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমতার মাধ্যমে আমলাদের লম্বা হাতকে খাটো করে দিতে পারে। এর জন্য তিনি প্রয়োজনবোধে নতুন আইনের সৃষ্টি করে তার যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে পারে। এর জন্য তিনি যা করতে পারেন তা হলো :
ক. তদন্ত কমিটি গঠন করবে যা আমলারা বুঝতে পারবে না।
খ. তদন্ত কমিটি ৩/৪ মাস অন্তর অন্তর তাদের রিপোর্ট পেশ করবে।
৯. প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক : বিশ্বের অধিকাংশ দেশের প্রধান নির্বাহী হলো সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। প্রধান নির্বাহী হিসেবে তিনি প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী। এ ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি আমলাদের হাতের মুঠোয় নিতে পারেন। এর জন্য তিনি দেশের গোয়েন্দা বিভাগকে কাজে লাগাতে পারেন। সেহেতু জনগণের স্বার্থে আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন যাতে তারা জনগণের অভিভাবক না হয়ে, জনগণের সেবক হতে পারে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায়, ‘জনগণের জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য জনগণ নয়। পরিশেষে আমরা বলতে পারি যদিও আমলাতন্ত্র সরকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তথাপি এর নিয়ন্ত্রণ করা অবশ্যই প্রয়োজন।