আবুল মনসুর আহমদের ‘হুযুর কেবলা’ গল্পের মূল প্রতিপাদ্য কেবল ভণ্ড মুখোশ উন্মোচন নয়, বাঙালি মুসলমান সমাজের অন্ধত্ব ও ধর্মব্যবসায়ীদের কুসংস্কার নির্দেশ করাও” আলোচনা কর।

অথবা, আবুল মনসুর আহমদ রচিত ‘হুযুর কেবলা’ গল্পে সমাজের যে চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে, তা তোমার নিজের ভাষায় লেখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
হুযুর কেবলা’ গল্পটি স্বনামধন্য গল্পকার আবুল মনসুর আহমদ বিরচিত ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত। গল্পটি একটি সামাজিক গল্প। এ গল্পে গল্পকার একদিকে যেমন সমাজের ধর্মব্যবসায়ীদের ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিয়েছেন তেমনি। ধর্মব্যবসায়ের মুখোশ উন্মোচন, তেমনি সমাজই অন্ধত্ব ও কুসংস্কার নির্দেশ করাও। লেখক সাবলীল ভাষায় ব্যঙ্গ-বিদ্রূেপের মাধ্যমে। অন্যদিকে বাঙালি মুসলমান সমাজের মধ্যকার অন্ধত্ব, গোঁড়ামি ও কুসংস্কাকেও তুলে ধরেছেন। গল্পের মূল প্রতিপাদ্য যেমন এই উভয় বিষয়কে পাঠক সমক্ষে তুলে ধরেছেন।
গ্রামীণ বাঙালি মুসলমান সমাজ : প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বাঙালি মুসলমানেরা অত্যন্ত সহজ, সরল, অকপট, ধর্মভীরু ও মুসলমান সমাজ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও ধর্মান্ধ। এ কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার কারণে এ সমাজে পীর প্রথা দত্তর মতো প্রভাব বিস্তার করে আছে। তথাকথিত কামেল পীরেরা এখনো গ্রাম্য জনপদে ফেরেশতার মত সমাদৃত হয়ে আসছে। গ্রামের সাধারণ মানুষেরা এ সকল পীরের মুখনিঃসৃত বাণীকে বেদবাক্য বলে মনে করে। সমাজের এ দুর্বলতাকে পুঁজি করে পীর সাহেবেরা তাদের ধর্মব্যবসায় জাঁকজমকের সাথে চালিয়ে যাচ্ছেন।
ধর্মব্যবসায় : উপমহাদেশের মুসলমানেরা চিরকালই ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। বিজ্ঞান শিক্ষার বিস্তার বিলম্বিত হওয়ার কারণে এতদঞ্চল ধর্মব্যবসায়ের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। মানুষের সরলতা ও বিশ্বাসকে মূলধন করে এই এলাকায় ধর্মব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসায় জমিয়ে তুলেছেন। এই ব্যবসায় পুঁজি লাগে না এবং ঝুঁকি কম। পীর মাশায়েকদের এদেশের মানুষ | মনোরঞ্জনের জন্য বরাবরই শ্রদ্ধা করে আসছে। এরা কোনো পাপ করতে পারে বলে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে না। তাই এঁদের মুরিদেরা সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। মুরিদদের এ মানসিকতাকে আশ্রয় করে জমে উঠে ধর্মব্যবসায়।
ধর্মব্যবসায়ী : ধর্মকে পুঁজি করে যারা ব্যবসায় করে তাদেরকে বলা হয় ধর্মব্যবসায়ী। বাঙালি মুসলমান সমাজে তথাকথিত পীর মাশায়েকরা এ সামাজিক অপকর্মটি করে থাকেন। এঁরা সহজ সরল গ্রাম) ধর্মভীরু মানুষকে আল্লাহ রাসূল ও কেতাব কুরআনের অপপ্রশ্ন শুনিয়ে বিভ্রান্ত করেন। অজ্ঞান অশিক্ষিত মুসলমান ছোয়াবের লোভে এ সকল পীরের মুরিদ হয়ে এদের পদসেবায় নিয়োজিত হয়। ধর্মব্যবসায়ীরা অত্যন্ত সুকৌশলে মুরিদদের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের কামনা-বাসনা চাওয়া-পাওয়া চরিতার্থ করেন। এঁরা মুরিদদের ভুলিয়ে ভালিয়ে নিজেদের সম্পদের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি কুবাসনাও পূর্ণ করেন। এ ধরনের এক ধর্মব্যবসায়ীর কথাই ‘হুযুর কেবলা’ গল্পে বিধৃত হয়েছে।
ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচন : ‘হুযুর কেবলা’ গল্পের পীর সাহেব বয়সে বৃদ্ধ। বর্ণনা মতে তাঁর তিন স্ত্রী বর্তমান। তিনি মুরিদদের বুজরুকির মাধ্যমে মোহাবিষ্ট করে রাখেন। সহজ সরল মুরিদেরা হুযুর যা বলেন তা অকপটে বিশ্বাস করে। পীর সাহেবের নারীদের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল। মুরিদানে গিয়ে তিনি পুরুষদের মজলিসের চেয়ে মেয়েদের ওয়াজের আসর বেশি পছন্দ করতেন। মেয়েদের মজলিসে বসে ওয়াজ করতে করতে তাঁর প্রায়ই জযবা আসত। এটা ছিল পীর সাহেবের ফাজলামি। এ সময় মুরিদেরা তাঁর হাত পা টিপে দিলে তিনি সুস্থ হতেন। মেয়েমহলে ওয়াজের সময় পীর সাহেবের নজর পড়ে বাড়িওয়ালার পুত্র রজবের সুন্দরী স্ত্রী কলিমনের উপর। পীরসাহেব স্থির করেন কলিমনকে নিজের জন্য হালাল করবেন। এ কু-ইচ্ছা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর দুই খলিফার সাথে গোপনে পরামর্শ করে এক ‘মোরাকেবা’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সুফি সাহেবের অচেতন (?) দেহে হুযু র রাসুলের আত্মাকে আনার কথা বলে তাঁকে দিয়ে কলিমনকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। উপস্থিত সকলেই এ ঘটনা বিশ্বাস করে প্রস্তাব সমর্থন করে। রজব তার স্ত্রীকে তালাক দিতে বাধ্য হয়। সকলের সহযোগিতা ও সমর্থনে কলিমনের সাথে পীর সাহেবের বিয়ে হয়ে যায়। গল্পকার পীর সাহেবের ভণ্ডামি ও প্রতারণার চিত্রটি সুন্দরভাবে এ গল্পে উপস্থাপন করেছেন। এ গল্পের মাধ্যমে আমাদের দেশের ধর্মব্যবসায়ীদের ভণ্ডামির মুখোশ সুন্দরভাবে উন্মোচিত হয়েছে। লেখক গ্রহসনের মেজাজে ধর্মীয় ভণ্ডামিকে তীব্র কটাক্ষবাণে জর্জরিত করেছেন।
সামাজিক অন্ধত্ব ও কুসংস্কার : সহজ সরল গ্রামবাসীদের সারল্যকে আশ্রয় করে পীর প্রথার প্রচলন হয়েছে মুসলিম সমাজে। আমাদের দেশের মুসলমানেরা ধর্মভীরু ও ধর্মপ্রাণ। ধর্মের কথায় তারা যে কোন কাজ করতে প্রস্তুত। আধুনিক শিক্ষার অভাবে তাদের মধ্যে অন্ধত্ব ও কুসংস্কার বাসা বেঁধে বসেছে। যে কোন বুজরুকি দিয়ে এ সমস্ত মানুষকে সহজে বশীভূত করা যায়। এ সকল মানুষ যুক্তিতর্কের ধার ধারে না। এরা আল্লাহকে ভয় পায় রাসূলকে মান্য করে। তাই আল্লাহর দোহাই দিয়ে রাসূলের ওছিলায় এদেরকে যা বুঝানো হয় এরা তাই সরলভাবে বিশ্বাস করে। এ সকল মানুষ নিজেরা কম জানে বলে অন্য যে কোনো জানেওয়ালাকে ফেরেশতা বলে গণ্য করে। যুক্তির চেয়ে আবেগ এদের কাছে বড়। এ সকল মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে পীর মাশায়েকরা নিজের স্বার্থসিদ্ধিতে মত্ত হন। এ পীরেরা যা বলেন তাই তারা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। নিঃশর্ত ভক্তি দিয়ে এরা পীরবন্দনায় মেতে উঠে। ‘হুযুর কেবলা’ গল্পে সমাজের অন্ধত্ব ও কুসংস্কারকে আশ্রয় করে পীর সাহেব নিজের স্বার্থ হাসিল করেছেন। গল্পকার এ গল্পে চমৎকারভাবে মানুষের অন্ধত্বের ভাষাচিত্র অঙ্কন করেছেন। রজবের ধর্মাদ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন পিতা ও অন্যরা পীরের
চালাকি বুঝতে না পেরে রজবের জীবনটাকে ছারখার করে দিয়েছে। আর ফলস্বরূপ ভণ্ড পীর নিজের কামলালসা চরিতার্থ করেছেন।
সমাজের বুক থেকে যতদিন এই অন্ধত্ব ও কুসংস্কারকে ঝেটিয়ে বিদায় করা না যাবে ততদিন পীর প্রথার উচ্ছেদ হবে না। এ অস্বত্ব ও কুসংস্কার নির্দেশ করাই ‘হুযুর কেবলা’ গল্পের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। পাশাপাশি ধর্মব্যবসায়ীদের ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচন করাও গল্পটির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আবুল মনসুর আহমদের ‘হুযুর কেবলা’ গল্পের মূল প্রতিপাদ্য কেবল ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচন নয়, বাঙালি মুসলমান সমাজের অন্ধত্ব ও কুসংস্কার নির্দেশ করাও- কথাটি সর্বৈব সত্য। লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ধর্মব্যবসায়ীদের ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচন করেছেন। পাশাপাশি তিনি আমাদের সমাজদেহে বিরাজমান অন্ধত্ব ও কুসংস্কারকে চিহ্নিত করেছেন। এ অন্ধত্ব, গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও অজ্ঞানতা দূর না হওয়া পর্যন্ত স্বার্থান্বেষী ধর্মব্যবসায়ীদের কুকর্মের অবসান হবে না। সমাজ থেকে এদের দৌরাত্ম্য হ্রাস পাবে না। আধুনিক শিক্ষাই আমাদেরকে এই দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b9%e0%a7%81%e0%a6%af%e0%a7%81%e0%a6%b0-%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%ac%e0%a6%b2%e0%a6%be-%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%aa-%e0%a6%86%e0%a6%ac%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a6%b8/