অথবা, আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলি বর্ণনা কর।
অথবা, আধুনিক রাষ্ট্রের ভূমিকা আলোচনা কর।
অথবা, আধুনিক রাষ্ট্র কী কী কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে? আলোচনা কর।
অথবা, আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলি সম্পর্কে বিবরণ দাও।
উত্তর ভূমিকা : জনসমষ্টি, ভূখণ্ড, সার্বভৌমত্ব, সরকার এ চারটি অপরিহার্য উপাদান নিয়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি। রাষ্ট্রের প্রকৃতির উপর তার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নির্ভর করে। রাষ্ট্রের প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যেমন বাদানুবাদের অন্ত নেই, তেমনি লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেও তাদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। সুতরাং, রাষ্ট্রের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনো সর্বসম্মত অভিমত জ্ঞাপন করা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলি : আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জন স্টুয়ার্ট মিল বলেন, “রাষ্ট্রের প্রকৃত কার্যাবলি সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিমত জ্ঞাপন করা অসম্ভব”। কারণ, বিভিন্ন সামাজিক অবস্থায় তা বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। সামগ্রিকভাবে জনকল্যাণই হলো রাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তবে বর্তমানে কল্যাণকর আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলিকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
ক. প্রাথমিক বা অপরিহার্য কার্যাবলি এবং
খ. ঐচ্ছিক কার্যাবলি।
ক. প্রাথমিক বা অপরিহার্য কার্যাবলি : রাষ্ট্রের পূর্ণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রকে যেসব কাজ অবশ্যই সম্পাদন করতে হয় তাই প্রাথমিক বা অপরিহার্য কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত। অপরিহার্য কার্যাবলি নিম্নরূপ:
১. সার্বভৌমত্ব রক্ষা : রাষ্ট্রের চারটি অপরিহার্য উপাদানের অন্যতম হলো সার্বভৌমত্ব। সার্বভৌমত্ব অর্জন না করলে যেমন রাষ্ট্র গঠিত হয় না, তেমনি সার্বভৌমত্ব হারালেও রাষ্ট্র বিলুপ্ত হয়। তাই সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা রাষ্ট্রের অপরিহার্য কাজ।
২. অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা : জনগণের জীবন ও সম্পত্তির পূর্ণ নিশ্চয়তা এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য রাষ্ট্রকে সামরিক এবং আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করতে হয়।
৩. পররাষ্ট্র বিষয়াবলি : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্দেশ্যে বিদেশে রাষ্ট্রদূত প্রেরণ, অন্য দেশের রাষ্ট্রদূতদের সাদর অভ্যর্থনা এবং বিদেশের সাথে বিভিন্ন ধরনের চুক্তি সম্পাদন রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ।
৪. শাসনকার্য পরিচালনা : রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রকে শাসন বিভাগ গঠন এবং বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন ও উপযুক্ত লোক নিয়োগ করতে হয়।
৫. আইন প্রণয়ন : আইন প্রণয়ন, আইন পরিবর্তন বা বাতিল প্রভৃতির জন্য রাষ্ট্রকে আইন বিভাগ গঠন করতে হয়।
৬. বিচারকার্য : ন্যায়বিচারের স্বার্থে রাষ্ট্রকে বিচার বিভাগ গঠন, সৎ ও দক্ষ বিচারক নিয়োগ করতে হয়।
৭. আর্থিক কার্যাবলি : খাজনা, কর নির্ধারণ ও আদায়, বাজেট প্রণয়ন, মুদ্রা প্রবর্তন প্রভৃতি রাষ্ট্রের আবশ্যিক আর্থিক কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত।
খ. ঐচ্ছিক কার্যাবলি : জনগণের কল্যাণের জন্য রাষ্ট্রকে যেসব কার্যাবলি সম্পাদন করতে হয় তা ঐচ্ছিক কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত। ঐচ্ছিক কার্যাবলি নিম্নরূপ :
১. শিক্ষা সংক্রান্ত কাজ : দেশের প্রত্যেকটি নাগরিককে সুশিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র বিভিন্ন স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পাঠাগার প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করে।
২. স্বাস্থ্য বিষয়ক কার্যাবলি : জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র হাসপাতাল, শিশুসদন, মাতৃসদন, পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র প্রভৃতি স্থাপন ও পরিচালনা করে থাকে।
৩. যোগাযোগ কার্যাবলি : দেশের অভ্যন্তরে এবং দেশের বাইরে যোগাযোগের প্রয়োজনে বিভিন্ন রাস্তা, পুল নির্মাণ,
ডাক, তার টেলিফোন ব্যবস্থা স্থাপন ও পরিচালনার ব্যবস্থা রাষ্ট্র করে থাকে।
৪. শিল্প-বাণিজ্য সংক্রান্ত কাজ : নতুন নতুন শিল্প স্থাপন ও শিল্পপতিদের শিল্প স্থাপনে উৎসাহ প্রদান, ব্যাংক, বিমা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত।
৫. শ্রমিক কল্যাণ : আধুনিক রাষ্ট্র শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য, বেতন, বাড়ি ভাড়া, ভাতা এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদিমপ্রদান করে।
৬. জনহিতকর কাজ : বর্তমানে প্রায় সব রাষ্ট্রই কৃষিঋণ প্রদান, খাল খনন, সেচের সুবিধা প্রদান, জনগণের জন্য বিনোদনের সুব্যবস্থাসহ বিভিন্ন জনহিতকর কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রের কার্যাবলি সম্বন্ধে নানা প্রকার মতবিরোধ থাকলেও দেশের নিরাপত্তা, ঐক্য ও সংহতি রক্ষা এবং সর্বাধিক পরিমাণ জনকল্যাণ সাধনই যে রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমান পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রই কল্যাণকর রাষ্ট্র। আর কল্যাণকর রাষ্ট্র হওয়ার কারণেই রাষ্ট্রের কার্যাবলি বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত ব্যক্তি ও সমাজের প্রয়োজন অনুসারে রাষ্ট্রের কার্যাবলি নির্ধারিত হয়।