মানুষের মধ্যে যা কিছু শ্ৰেষ্ঠ তা সংকীর্ণভাবে কোন জাতির মধ্যে বদ্ধ হতে পারে না, তা কৃপণের অবরুদ্ধ ভাণ্ডারের সম্পদ নয়”- ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধের আলোকে উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।

অথবা, সভ্যতার আন্তর্জাতিকতা সম্পর্কে তোমার অভিমত ব্যক্ত কর।
উত্তরঃ ভূমিকা :
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটি রচনা করেন তাঁর আশিতম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে পাঠ করার উদ্দেশ্যে। জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে ইংরেজ সভ্যতার সংকীর্ণতার যে মুখোশ তাঁর সামনে উন্মোচিত হয়েছিল তারই নৈর্ব্যক্তিক বর্ণনা প্রবন্ধটিতে তুলে ধরা হয়েছে। প্রবন্ধটি লেখকের বস্তুনিষ্ঠ আত্মসমালোচনার একখানা প্রামাণ্য দলিল। রবীন্দ্রনাথ অকপটে নিজের মধ্যকার ভ্রান্ত উপলব্ধিকে এ নিবন্ধে ব্যক্ত করেছেন। ইউরোপীয় সভ্যতার সংকীর্ণতাকে তিনি কঠোর ভাষায় সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি। কবি পাশ্চাত্য সভ্যতার মানবমৈত্রীর পরিচয়কে সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে অবরুদ্ধ করে রাখার প্রয়াসের সমালোচনা করে উক্তিটি করেছেন।
ইংরেজ সভ্যতার প্রকৃত রূপ : ইংরেজি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সাথে ভারতীয়দের প্রত্যক্ষ পরিচয় আরম্ভ হয়েছিল এদেশে তাদের আগমনের পর থেকে। তাদের মহৎ সাহিত্যের উচ্চশিখর থেকে যে মানবতার বাণী ঘোষিত হয়েছিল তা কবিকে মুগ্ধ করেছিল। তাই তখন ইংরেজি ভাষার ভিতর দিয়ে ইংরেজি সাহিত্যকে জানা ও উপভোগ করা ছিল মার্জিতমনা বৈদগ্ধ্যের পরিচয়। সারা বিশ্ব তখন মুখরিত ছিল বার্কের বাগ্মিতায়, মেকলের ভাষা প্রবাহের তরঙ্গভঙ্গে; প্রতিনিয়তই আলোচনা চলত শেক্সপিয়ারের নাটক নিয়ে, বায়রনের কাব্য নিয়ে এবং তখনকার পলিটিক্‌সে সর্বমানবের বিজয় ঘোষণায়। তখন ভারতীয়রা স্বজাতির স্বাধীনতার সাধনা আরম্ভ করলেও অন্তরে অন্তরে ছিল ইংরেজ জাতির ঔদার্যের প্রতি বিশ্বাস। কারণ মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয় দেখাগিয়েছিল ইংরেজ চরিত্রে। তাই রবীন্দ্রনাথসহ আরো অনেকে আন্তরিক শ্রদ্ধা নিয়ে ইংরেজকে হৃদয়ের উচ্চাসনে বসিয়েছিলেন। ইংরেজ- সভ্যতা ভারতীয়দের সামনে জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত করে দিয়েছিল। সনাতনপন্থি ভারতীয়রা নিজেদেরকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার সুযোগ পেয়েছিল সে সভ্যতার কাছে।
পাশ্চাত্য সভ্যতার সংকীর্ণতা : মানবমৈত্রীর যে মহান বাণী ধারণ করে পাশ্চাত্য সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে দেখা গেল ইংরেজরা তা কেবল নিজের দেশ ও জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইল। সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা তাদেরকে নিপীড়কে পরিণত করল। ভারতবর্ষে তারা নখদন্ত বিস্তার করে বিশ্বমানবতাকে পদে পদে অপমানিত করে চলল। সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিত রূপে স্বীকার করেছিল, রিপুর তাড়নায় তারা তাকে অনায়াসে লঙ্ঘন করে গেল। পাশ্চাত্য সাহিত্যের রসসম্ভোগে মত্ত রবীন্দ্রনাথ একদিন বাধ্য হলেন ঐ বেষ্টন থেকে বেরিয়ে আসতে। সেদিন ভারতবর্ষের জনসাধারণের যে নিদারুণ দারিদ্র্য তাঁর সম্মুখে উদ্ঘাটিত হলো তা হৃদয়বিদারক। যতদিন তিনি সভ্যজগতের মহিমাধ্যানে একান্ত মনে নিবিষ্ট ছিলেন তখন কোনদিন সভ্যনামধারী মানব আদর্শের এতবড় নিষ্ঠুর বিকৃত রূপ কল্পনা করতেই পারেননি। পাশ্চাত্য সভ্যতার সংকীর্ণতার কারণেই লেখকের এ নিদারুণ ভাবান্তর ঘটেছিল।
ইংরেজ সভ্যতার নগ্নরূপ : জীবনের শেষপ্রান্তে এসে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ সভ্যতার নগ্নরূপটি হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন, যে যন্ত্রশক্তির সাহায্যে ইংরেজ আপনার বিশ্বকর্তৃত্ব রক্ষা করে এসেছে তার যথোচিত চর্চা থেকে ভারতবর্ষকে বঞ্চিত রেখেছে। অথচ সে যন্ত্রশক্তির সাহায্যে জাপান ও রাশিয়া দেখতে দেখতে সম্পদশালী হয়ে উঠল। অথচ বিশাল ভারতবর্ষ ইংরেজ সভ্যশাসনের জগদ্দল পাথর বুকে নিয়ে তলিয়ে পড়ে রইল নিরুপায় নিশ্চলতার মধ্যে। সভ্য শাসনের চালনায় ভারতবর্ষে সকলের চেয়ে যে দুর্গতি সেদিন মাথা তুলে উঠেছিল সে কেবল অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-আরোগ্যের শোকাবহ অভাব মাত্র নয়, সে হচ্ ছে ভারতবাসীর মধ্যে অতি নৃশংস আত্মবিচ্ছেদ। Law and order’ এর দারোয়ানি নিয়ে তারা Devide and rule’ নীতি কার্যকরী করে ভারতীয়দের বিভিন্ন জাতিসত্তায় বিভক্ত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করল। ইংরেজ সভ্যতার এ নৃশংস নগ্নরূপটি লেখক প্রথম জীবনে প্রত্যক্ষ করতে পারেননি। শেষ জীবনে তা তিনি উপলব্ধি করে এ নিবন্ধে দ্বিধাহীন চিত্তে ব্যক্ত করেছেন।
ইংরেজি সাহিত্যের সর্বজনীনতা : উৎকর্ষতার বিচারে ইংরেজি সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে সর্বোৎকৃষ্ট। বার্ক, মেকলে, শেক্সপিয়ার, বায়রন প্রমুখ কবি সাহিত্যিকের রচনা তখন সারা পৃথিবীতে সমাদৃত হয়েছে উৎকর্ষগুণে। এ সাহিত্যকে শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করেছিল ভারতবর্ষ। কারণ মানুষের মধ্যে যা কিছু শ্রেষ্ঠ তা সংকীর্ণভাবে কোন জাতির মধ্যে বদ্ধ হতে পারে না; তা কৃপণের অবরুদ্ধ ভাণ্ডারের সম্পদ নয়। যুগে যুগে দেশে দেশে যখন যা কিছু উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত হয়েছে তা সকলেই লুফে নিয়েছে। ভারতীয়রা যখন সনাতনপছি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সাহিত্য পাঠে অভ্যস্ত ছিল তখন ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবে তারা ঐ সকল সাহিত্য আলমিরায় তুলে রেখে শেক্সপিয়ার-বায়রন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইংরেজের যে সাহিত্যে ভারতবাসীর মন সেদিন পুষ্টি লাভ করেছিল। আজ পর্যন্ত তার প্রভাব কাটে নি। সুতরাং ইংরেজি সাহিত্য কেবল ইংরেজদের সাহিত্য নয় তা সর্বজনীন সাহিত্য।
প্রাবন্ধিকের মূল্যায়ন : রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “বৃহৎ মানববিশ্বের সাথে আমাদের প্রত্যক্ষ পরিচয় আরম্ভ হয়েছে সেদিনকার ইংরেজ জাতির ইতিহাসে। আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে উদ্ঘাটিত হলো একটি মহৎ সাহিত্যের উচ্চশিখর থেকে ভারতের এ আগন্তুকের চরিত্র পরিচয়। তখন আমাদের বিদ্যালাভের পথ্য পরিবেশনে প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য ছিল না। প্রকৃতি তত্ত্বেও বিশেষজ্ঞের সংখ্যা ছিল অল্পই। তখন ইংরেজি ভাষার ভিতর দিয়ে ইংরেজি সাহিত্যকে জানা ও উপভোগ করা ছিল মার্জিতমনা বৈদগ্ধ্যের পরিচয়।” এ বক্তব্যের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি সাহিত্যপ্রীতি প্রকটরূপে প্রকাশ পেয়েছে। এ বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় তিনি প্রশ্নে উদ্ধৃত উক্তিটির মাধ্যমে ইংরেজি সাহিত্যের সর্বজনীনতাকে সামগ্রিক বিচারে সর্বজনগ্রাহ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পেক্ষিতে বলা যায় যে, ইংরেজি সাহিত্য কেবল ইংরেজ জাতির ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। উৎকর্ষতার গুণে এ সাহিত্য পৃথিবীর সকল জাতিরই গর্বের বস্তু। ইংরেজরা যদি একে কেবল নিজেদের বলে নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় তাহলে তাতে তাদের সংকীর্ণতারই প্রকাশ ঘটবে। ইংরেজি সাহিত্য তাতে গৌরবান্বিত হবে না।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b8%e0%a6%ad%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%95%e0%a6%9f-%e0%a6%aa%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a7-%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a7%80%e0%a6%a8%e0%a7%8d/