প্রশ্নের উত্তর

মধ্যযুগের বাঙালি দর্শন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।

অথবা, বাঙালি দর্শনের মধ্যযুগ সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
অথবা, মধ্যযুগীয় বাঙালি দর্শনের প্রকৃতি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, মধ্যযুগের বাঙালি দর্শন সম্পর্কে যা জান লেখ।
অথবা, মধ্যযুগের বাঙালি দর্শনের স্বরূপ তুলে ধর।
অথবা, মধ্যযুগের বাঙালি দর্শন কি রূপ ছিল।
উত্তর।। ভূমিকা :
অন্যান্য জাতির মতো বাঙালি জাতিরও সমৃদ্ধ দর্শনের ইতিহাস রয়েছে। বাঙালি দর্শনের এ ইতিহাসকে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক এ তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মধ্যযুগ হলো প্রাচীন যুগ থেকে উত্তোরণ এবং আধুনিক যুগে পদার্পণের ভিত্তিস্বরূপ। বাঙালি দর্শনের ইতিহাসে মধ্যযুগ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
বাঙালি দর্শনের মধ্যযুগ : দ্বাদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালকে বাঙালি দর্শনের মধ্যযুগ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রাচীন যুগে বৈদিক ধর্ম ও বৌদ্ধ-জৈন ধর্মের প্রভাব থাকলেও মধ্যযুগে এসে তা হ্রাস পেতে থাকে। বিশেষ করে বাংলায় মুসলিম সম্প্রদায়ের আগমন ও ইসলামের বিকাশের সাথে সাথে বাঙালি দর্শনে হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রভাব হ্রাস পায়। এ দেশীয় সংস্কৃতি ও চিন্তাধারার সাথে মুসলিম চিন্তাধারার সমন্বয়ের মাধ্যমে বাংলায় ইসলামি, বৈষ্ণবীয় এবং বাউল দর্শন বিস্তার লাভ করে, যা বাঙালির নিজস্ব দর্শন নামে খ্যাত।
ক. ইসলামি দর্শন : মধ্যযুগে বাংলা মুসলমানদের শাসনাধীনে আসার ফলে আরব বিশ্বের উন্নত সংস্কৃতির সাথে এ দেশীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটে। মুসলিম বিজয়ের পরে এবং পূর্বে যেসব সুফি সাধক এসেছিলেন তাদের মাধ্যমে এদেশে অধ্যাত্মবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটে। মুসলমান শাসকদের জ্ঞানবিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে এ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।মুসলমানদের একত্ববাদ, অধ্যাত্মবাদ, কর্মবাদ প্রভৃতি দ্বারা বাঙালি দর্শন প্রভাবিত হয়েছে ব্যাপকভাবে এবং এ ভাবেই সমৃদ্ধতর দর্শনে পরিণত হয়েছে।
খ. বৈষ্ণবীয় দর্শন : ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রসার ভ্রাতৃত্ববোধ বাংলার অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের যখন ধর্মান্তরিত করে।চলেছে, ঠিক তখন শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব হয়। তিনি প্রেম-দর্শন খ্যাত গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদ প্রচার করেন। তিনি বিদ্যমান মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তুলে দেন। ফলে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, যবন সব মিলে এক মানব জাতির অন্তর্ভুক্ত হলো। তার হাত ধরেই মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠিত হলো। বাঙালি হিন্দুসমাজ লাভ করলো এক অভিনব ও বিস্ময়কর শক্তি ও চেতনা।
গ. বাউল দর্শন : চৈতন্যোত্তরকালে ইসলামের সুফি ধারা, বৈষ্ণবীয় ধারা ও হিন্দু ধারার সমন্বয়ে বাংলা ভূখণ্ডে আত্মপ্রকাশ করে নতুন এক মানবতাবাদী মতবাদ বা তত্ত্ব, যা বাউল তত্ত্ব নামে পরিচিত। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত বাঙালি তত্ত্ব হিসেবে বাউল তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে এবং বাঙালি দর্শনের অন্যতম শক্তিশালী অধ্যাত্মবাদী ধারার স্বীকৃতি পেয়েছে। তাদের তত্ত্ব দর্শনের মধ্যে প্রেম, মৈথুন তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি, বাঙালি দর্শনের ইতিহাসে মধ্যযুগ একটি বিশেষ গুরুত্বের স্বীকৃতি বহন করে। এ সময়ই হিন্দু-বৌদ্ধ-ইসলাম ধর্ম বাঙালি দর্শনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে সমন্বয়বাদী দর্শনতত্ত্বে রূপ দাম করে। একাধিক বৃহৎ ধর্ম দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে এরূপ প্রভাবিত দর্শন খুব একটা দেখা যায় না। মূলত এরূপ সমন্বয়ের কারণেই বাঙালি দর্শন সমৃদ্ধ দর্শন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

হ্যান্ডনোট থেকে সংগ্রহীত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!