বৈষ্ণববাদের উৎস প্রতিপাদন কর।

অথবা, বৈষ্ণবাদের উৎপত্তি হয়েছে কিভাবে?
অথবা, বৈষ্ণববাদের উৎস কি?
অথবা, বৈষ্ণববাদের উদ্ভব সম্পর্কে লেখ।
অথবী, বৈষ্ণববাদের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে লেখ।
অথবা, তোমার মতে বৈষ্ণববাদের উৎপত্তি হয়েছে কিভাবে?
উত্তর৷ ভূমিকা : বৈষ্ণব ধর্মমতের সার বা তত্ত্ব কথা-নিয়েই গড়ে উঠেছে বৈষ্ণব দর্শন। বিষ্ণুর উপাসকরাই বৈষ্ণব। এ মতে ঈশ্বরকেই বিষ্ণু বা নারায়ণ, হরি বা কৃষ্ণ বলা হয়। তাঁর নামই একমাত্র উপাস্য। বৈষ্ণব সমাজ বিষ্ণুর নাম সংকীর্তন ও নাম জপকে আধ্যাত্ম সাধনার প্রধান অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেন। আর তাঁদের এ সাধনা কর্ম বা জ্ঞানের
উপর নয় বরং প্রেমভক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। বাংলায় এ প্রেমদর্শনের প্রবর্তক ও প্রতিষ্ঠাতা শ্রীচৈতন্যদেব হলেও এর উৎসমূল নিহিত অতি প্রাচীন কালের চিন্তায়।
বৈষ্ণববাদের উৎস : বৈষ্ণববাদের মূলকথা প্রেমভক্তি করুণা। বৈষ্ণব ধর্মের প্রধান অনুষ্ঠান শ্রীবিষ্ণুর নাম কীর্তন। বিষ্ণুর উপাসনা বিষয়ে সবচেয়ে প্রাচীন দলিল ঋগ্বেদ সংহিতা। এ ঋগ্বেদেই ব্যাখ্যাত বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের মূল
স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য। ঋগ্বেদের অনেক সূক্তে বিষ্ণুর উল্লেখ আছে। ঋগ্বেদের তেমনি একটি সূক্তের ব্যাখ্যাকার সায়নাচার্যের ব্যাখ্যানুসারে বিষ্ণুই আদি দেবতা। তাঁর নামই উপাস্য। কারণ তাঁর নাম জ্যোতিময়। তাঁর চিন্ময় নাম সাধনার দ্বারা সাধকের উপর করুণা বর্ষিত হয়। ফলে সাধক তাঁর স্বরূপ শক্তি লাভ করার শক্তি অর্জন করতে সমর্থ হয়। কারণ তাঁর
নামের এক মারাত্মক শক্তি বা মহিমা আছে। সাধক নাম জপ বা সাধনার দ্বারা বিষ্ণুর সাক্ষাৎ লাভ করতে পারে বা তাঁকে জানতে পারে। মোটকথা ঋগ্বেদে বিষ্ণুই পরম তত্ত্ব হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছেন। তিনিই সূর্য, উষা, অগ্নি প্রভৃতি দেবতাদের সৃষ্টিকর্তারূপে গণ্য হয়েছেন। এজন্যই ঋগ্বেদে বিষ্ণুকে “ঋতস্য গর্ভঃ” বলা হয়েছে। ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলোতে বিষ্ণুর প্রাধান্য বিস্তারের প্রমাণ পরিলক্ষিত। ঐত্তেরীয় আরণ্যক ও শতপথ ব্রাহ্মণেও বিষ্ণুর প্রাধান্য সম্পর্কে আখ্যায়িকা আছে। এসব আখ্যায়িকা থেকে প্রমাণিত হয় যে, বৈদিক সাহিত্যে বিষ্ণু দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। স্বীয় শক্তির বিস্তারের দ্বারা তিনি জগৎ বেদ ও বাক্যের সর্বময় কর্তারূপে প্রতিপন্ন হন। এরূপে তাঁর সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপী ঈশ্বরত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ঋগ্বেদে বৈষ্ণব ধর্মের যে অঙ্কুরোদগম হয় পরবর্তীতে উপনিষদ, মহাভারত, আগমশাস্ত্র, পুরাণ ও ধর্ম
সংহিতার মধ্য দিয়ে তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং নানামুখী গতি সঞ্চার করে। আরও পরবর্তীকালে অবতার তত্ত্বের চাল প্রচলন ও প্রতিষ্ঠা হয়। অবতার তত্ত্বে বিষ্ণু নারায়ণ, বাসুদেব, কৃষ্ণ, বুদ্ধ প্রভৃতি দশ অবতারের সাথে যুক্ত হয়ে যান। বাংলায় এ বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের ভিত্তি প্রথম রচনা করেন রামানুজ তাঁর বিশিষ্টাদ্বৈতাবাদে। শঙ্করের অদ্বৈতবাদ ছিল
জ্ঞানমুখী ও প্রেমভক্তি বিরোধী। এ নির্জলা অদ্বৈতবাদের প্রভাবে যে প্রেমভক্তিবাদ হারিয়ে ফেলেছিল তার প্রাণশক্তি, তাতেই নব প্রাণের সঞ্চার করেন রামানুজ। আর এ মতই প্রেমধর্ম বা ভক্তিধর্মরূপে বাংলায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে শ্রীচৈতন্য দেবের হাতে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানগুরু সক্রেটিস যেমন শ্রীচৈতন্যদেব তেমনি কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি। সংস্কৃত ভাষায় বর্ণিত মাত্র আটটি শ্লোকের মাধ্যমে তিনি জয়গান করেন তাঁর ভক্তিবাদ ও প্রেমাত্মক দর্শনের। এ দর্শনেরই বিস্তৃত টীকা ভাষ্য রচনা করেন বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামী। তাঁরা হলেন রূপ, সনাতন, রঘুনাথ দাস, রঘুনাথ ভট্ট, গোপাল ভট্ট ও জীব গোস্বামী। শ্রীচৈতন্যের এ প্রেমভক্তিবাদি অবলম্বনেই রচিত হয় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ধারা ‘শ্রীচৈতন্য জীবনীকাব্য’ ও ‘বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য’। যা বাঙালিকে পরবর্তী দুইশত বছর প্লাবিত করে এক ভাবপ্লাবনে। বাঙালি তখন গভীরভাবে নিয়োজিত থাকে দার্শনিক তত্ত্ববিচার, তর্ক বিচার ও রসতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে। এ কারণেই বাংলায় শ্রীচেতন্যদেবের আবির্ভাব সম্পর্কে গৌড়ীয় বৈষ্ণব আচার্যগণ বলেন, “কলিতে নামের মাহাত্ম্য প্রচারের দ্বারা জনচিত্তকে শুদ্ধ
ও ভাগবৎ সাক্ষাৎকারের উপযোগী করে তোলার জন্যই বিশেষ করে বাংলাদেশে শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব।
উপসংহার : অবশেষে বলা যায়, মধ্যযুগের বাঙালির ধর্ম ও মনন সাধনায় বৈষ্ণববাদ একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। বৈষ্ণবাদের মূলবীজ ঋগ্বেদে রোপিত হলেও শ্রীচৈতন্যের হাতেই তা ফুলে ফলে সুরভিত হয়ে উঠে। যদিও তিনি কোন গ্রন্থ রচনা করেননি তথাপি তাঁর জীবন ও দর্শনকে নিয়ে রচিত মধ্যযুগের অমর সাহিত্য ধারা চৈতন্য জীবনীকাব্য
ও বৈষ্ণব পদাবলিতেই তাঁর দর্শনচিন্তা বিধৃত হয়েছে। তাই এগুলোই বাংলার গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়।