বাংলার প্রাচীন জনপদগুলোর বিবরণ দাও।

অথবা, প্রাচীনকালে কোন কোন জনপদ নিয়ে বাংলা গঠিত হয়েছিল?
উত্তর৷ ভূমিকা : প্রাচীন বাংলায় জনপদগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বলতে আমরা যে ভূখণ্ডকে বুঝি, প্রাচীনযুগে এসব অঞ্চলের কোনো বিশেষ নাম ছিল না। তখন ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল ভিন্ন ভিন্ন নামে ও খণ্ডে বিভক্ত ছিল। এ জনপদগুলোর সীমানা বা বিস্তৃতি সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
কেননা বিভিন্ন সময়ে এ জনপদগুলোর সীমানা হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেছে। তবে কালের বিবর্তন প্রক্রিয়ায় বর্তমান বাংলা বা
বাংলাদেশ নাম ধারণ করেছে।
প্রাচীন বাংলার জনপদগুলোর বিবরণ : প্রাচীন বাংলার জনপদগুলো ছিল ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র সত্তা। যেমন-
১. বঙ্গ : বঙ্গ খুবই প্রাচীন জনপদ। ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বোধায়নের ধর্মসূত্রে কালিদাসের রঘুবংশ রামায়ণে অযোধ্যার সাথে মিত্রতা স্থাপনকারী দেশগুলোর তালিকায় বঙ্গের নাম সুস্পষ্টভাবে আছে। বৃহৎ সংহিতায় উপবঙ্গ নামে একটি জনপদের কথা জানা যায়। চন্দ্ররাজের মেহেরৌ লী শিলালেখ চালুক্য
রাজবংশের ইতিবৃত্তে বঙ্গ জনপদের উল্লেখ আছে। মহাভারতে (সভাপূর্ব ২৯ অধ্যায়) বঙ্গ, পুণ্ড্র, সূক্ষ্ম, তাম্রলিপ্ত এগুলো পৃথক রাজ্য বলে উল্লেখ আছে। বল্লাল সেনের সময় দ্বাদশ শতাব্দীতে বর্তমান বঙ্গদেশ রাঢ়, বরেন্দ্র, বাগড়ী, বঙ্গ এ চারটি৷ প্রদেশে বিভক্ত ছিল। মধ্যযুগে রচিত দিগ্বিজয় প্রকাশের বিবরণ অনুযায়ী বঙ্গ ছিল পুণ্ড্র, তাম্রলিপ্ত ও সূক্ষ্মের সংলগ্ন দেশ। পরবর্তী সাক্ষ্যপ্রমাণে মনে করা হয় যে, ভাগীরথী ছিল বঙ্গের পশ্চিম সীমা। হেমচন্দ্র রচিত অভিধান ‘চিন্তামণি’ নামক গ্রন্থ
থেকে জানা যায় যে, ব্রহ্মপুত্র নদীর পূর্ব উপকূল বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পালবংশ যখন ক্ষীণবল তখন বঙ্গ জনপদ দুভাগে বিভক্ত ছিল। এছাড়া শিলালিপিতে বিক্রমপুর ও নাব্য এ দুটি নামে বঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। অতএব প্রাচীন বঙ্গ ছিল বর্তমান বাংলার পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল । যথা : ঢাকা, ফরিদপুর ও বৃহত্তম ময়মনসিংহ জেলাসমূহের সম্মিলিত রূপ।
২. পুণ্ড্র : প্রাচীন বাংলায় পুণ্ড্র একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। পুণ্ড্র একটি প্রাচীন জাতিমূলক নাম। এরা উত্তরবঙ্গে বাস করত বুলে এ অঞ্চল পুণ্ড্রদেশ বা পুণ্ড্রবর্ধন নামে খ্যাত ছিল। বৈদিক সাহিত্য ও মহাকাব্যে এদের উল্লেখ আছে।
মহাভারতের দিগ্বিজয় পর্বে বলা হয়েছে, এ পুণ্ড্র জাতি আধুনিক মুঙ্গেরের পূর্বদিকে বসবাস করত। রাজত্ব করত কুলী নগরের উপকূলে। পরে বিভিন্ন লিপি ও পরিব্রাজকের বিবরণী থেকে জানা যায়, পুণ্ড্র জাতির অবস্থান পুণ্ড্রবধর্ন ও উত্তর বাংলার এক জায়গা। ভবিষ্য পুরাণ অনুযায়ী সাতটি দেশ পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যথা : গৌড়, বরেন্দ্র, নাবিত্তি, সূক্ষ্ম, ঝাড়খণ্ড, বরাহভূমি, বর্ধমান ইত্যাদি। প্রাচীন তাম্রশাসনে আছে পুণ্ড্রবর্ধন ভূক্তান্তপাতি বঙ্গে বিক্রমপুর ভাগে। পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী ছিল পুণ্ড্রনগর । প্রাচীনকালে এটি একটি সুপ্রসিদ্ধ নগরী ছিল। বগুড়া জেলা শহর থেকে সাত মাইল উত্তরে অবস্থিত মহাস্থানগড়ই প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন নগরীর ধ্বংসাবশেষ ছিল বলে পণ্ডিতরা মনে করেন।
:
৩. ঘরে বা রেহী বরেন্দ্রী বা বরেন্দ্র অঞ্চল পুত্রবর্ধন জনপদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। জনপদের প্রধান শহর মৌর্য ও তওঁ আমলে প্রাদেশিক শাসনকর্তার কেন্দ্র। পুণ্ড্রবর্ধনপুরের অবস্থান ছিল এ বরেন্দ্রী এলাকায়। এ এলাকার অবস্থান সম্পর্কে বলতে গিয়ে সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ গ্রন্থে বলা হয়েছে গঙ্গা আর করতোয়ার মধ্যে যে
ভূখও বরেন্দ্রী ছিল তারই নাম। ‘তবকাত-ই-নাসিরি’ নামক গ্রন্থে এটি গঙ্গা নদীর পূর্ব ভাগে অবস্থিত লক্ষণাবতী
রাজ্যের অংশ বলে বর্ণিত হয়েছে।

  1. রাঢ় বীরভূম, বর্ধমান ও ভাগীরথী নদীর পশ্চিমাঞ্চলই হলো রাঢ় জনপদ। সেখানকার রাঢ় উপজাতিদের নামানুসারে এ জনপদের নামকরণ করা হয় রাঢ় জনপদ। এ জনপদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় জৈনপুথি আচারঙ্গ
    সূত্রে। জনপদের উত্তরতম সীমায় গঙ্গা ও ভাগীরথী পূর্ব সীমায়ও নদী, মাঝের অংশটুকু রাঢ় জনপদ। রাঢ়ের দুই অংশ সূক্ষ্মভূমি ও বজ্রভূমি। অজয় নদ ছিল রাঢ়ের দুভাগে মাঝের সীমারেখা। শ্রী ধারাচার্যের ‘ন্যায়কান্ডালি’ নামক গ্রন্থে দক্ষিণ রাঢ় দেশের উল্লেখ আছে। অজয় নদের উত্তর দিকে যে ভূভাগ তারই নাম উত্তর রাঢ়। উত্তর রাঢ়ের উত্তর সীমা, ছিল রাজমহল পর্যন্ত বিস্তৃত।
    ৫. গৌড়: গৌড় নামটি সুপরিচিত হলেও গৌড় বলতে কোন অঞ্চল বুঝায় এ নিয়ে মতভেদ আছে। আর যে এলাকা গৌড় নামে অভিহিত হতো, কেনই বা এ নামে অভিহিত হতো তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে গৌড় নামটি যে প্রাচীন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। পাণিনির ব্যাকরণ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও বাৎসায়নের কামসূত্র নামক গ্রন্থে গৌড়ের সমৃদ্ধির কথা
    উল্লিখিত হয়েছে। হর্ষবর্ধনের অনুশাসনসমূহ থেকে জানা যায় যে, মৌখরী রাজ ঈশান বর্মণ গৌড়বাসীকে পরাজিত করে সমুদ্র পর্যন্ত বিতাড়িত করেন। বরাহমিহিরের বৃহৎ সংহিতায় দেখা যায় যে, গৌড় অন্যান্য জনপদ অপেক্ষা একটি আলাদা জনপদ। ভবিষ্য পুরাণে গৌড়ের স্থান নির্দেশ করেছে আধুনিক বর্ধমানের উত্তরে পদ্মার দক্ষিণে।
    ৬. হরিকেল : প্রাচীন বাংলার একটি সুপ্রাচীন জনপদ হলো হরিকেল। কান্তিদেবের চট্টগ্রামে প্রাপ্ত তাম্রলিপিতে নবম শতকে হরিকেল জনপদের নাম পাওয়া যায়। চন্দ্রবংশীয় লিপিতেও হরিকেল রাজ্যের নাম উল্লেখ আছে। আনুমানিক অষ্টম৷শতাব্দীতে রচিত ‘আর্যমশ্রীমূলকল্প’ গ্রন্থে ‘বঙ্গ’, ‘সমতট’ এবং ‘হরিকেল’ নাম পাওয়া যায়। হরিকেল নামাঙ্কিত মুদ্রায়ও৷ (চট্টগ্রাম, কুমিল্লা এবং সিলেটকে) এ জনপদের অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়।
    ৭. সমতট : বাংলায় একটি অতিপরিচিত জনপদ হলো সমতট। এটি বাংলায় দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত বলে ধারণা করা
    হয়। কালিদাসের রঘুবংশ কাব্যের নায়ক সমুদ্রগুপ্ত এ অঞ্চলের শাসক ছিলেন বলে মনে করা হয়। সপ্তম শতাব্দীতে ইৎসিং
    এর বর্ণনায়ও সমতট এর উল্লেখ আছে। মেঘনার পরবর্তী অঞ্চলকে সমতট এর অন্তর্ভুক্ত বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া
    চন্দ্রদের লিপিতে দেব পর্বত ও সমতট এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
    ৮. তাম্রলিপ্তি : হরিকেলের উত্তরে অবস্থিত ছিল তাম্রলিপ্তি। এ তাম্রলিপ্তির উল্লেখ পাওয়া যায় মহাভারতের ভীষ্মের দিগ্বিজয় পর্বে। বর্তমান মেদিনীপুর ছিল তাম্রলিপ্তির প্রাণকেন্দ্র। তবে জনপদ হিসেবে এর সাম্রাজ্যসীমা জানা যায় না। হিউয়েন সাং এর মতে, এ অঞ্চল সমতট থেকে ১৫০ মাইল দূরে ২৩৩ মাইল জায়গা জুড়ে বিস্তৃত ছিল।
    ৯. চন্দ্রদ্বীপ : চন্দ্রদ্বীপ একটি ক্ষুদ্র জনপদ। রামপাল তাম্রশাসনে ত্রৈলোক্যচন্দ্রের শাসনাধীন ভূখণ্ডরূপে চন্দ্রদ্বীপের উল্লেখ আছে। আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে বাকলা পরগনা বর্তমানে বরিশাল জেলার অন্তর্গত। মধ্যযুগে চন্দ্রদ্বীপ ছিল বর্তমান বরিশাল জেলার অংশবিশেষের মাঝে সীমাবদ্ধ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান।
    ১০. বঙ্গাল : দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন লিপি শামস-ই-সিরাজ আফিফ লিখিত ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহীতে’ বঙ্গ ও বঙ্গাল এ দুটি নামই আলাদাভাবে উল্লিখিত হয়েছে। এ বঙ্গাল থেকে গোটা বাংলার নাম হয় সুবা বাংলা।
    উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাচীন বাংলার জনপদগুলো ছিল প্রাচীন বাংলার উল্লেখযোগ্য নগরী যার মাধ্যমে প্রাচীন বাংলার উল্লেখযোগ্য৷ নগরীর সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা যায় যা প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য
    বহন করে। তবে প্রাচীনকালে বাংলার সুনির্দিষ্ট সীমানা ছিল না বলে যুগে যুগে এর সীমানা ওআয়তনের পরিবর্তন হয়েছে। খুব সম্ভবত গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর জনপদগুলো স্ব-স্ব ভৌগোলিক স্বাতন্ত্র্য বিলোপ করে একসাথে একীভূত হয়ে বাংলা নামে আত্মপ্রকাশ করে।