General Knowledge

বাংলাদেশে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ ও দূরীকরণের উপায়সমূহ আলোচনা কর ।

অথবা, বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ ও প্রতিকারের উপায় কীচা বর্ণনা কর।
অথবা, কী কারণে বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে? প্রতিরোধের উপায়সমূহ বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ এবং শিশুরাই জাতির কর্ণধার। এ প্রত্যাশা নিয়েই পিতা-মাতা তার সন্তানকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। বর্তমানে দেশের প্রায় ৯৫% ভাগ ছেলেমেয়ে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হয়ে
থাকে। তাছাড়া ‘শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি গ্রহণের পর বাংলাদেশের শিশুরা স্কুলমুখী হয়েছে বলা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনের উপযোগী প্রায় ১ কোটি শিশু বাংলাদেশে আছে। কিন্তু বাংলাদেশের শিশুদের ক্ষেত্রে একটু বেশি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় তা হলো প্রাথমিক স্কুল থেকে শিশুদের ঝরে পড়া।
প্রাথমিক স্কুল থেকে শিশুর ঝরে পড়ার কারণ : প্রাথমিক স্কুল থেকে শিশুর ঝরে পড়ার পিছনে অবশ্য বহুবিধ কারণ আছে। এ কারণগুলোর নিম্নলিখিতগুলো প্রধান ।
১. দারিদ্র্য : প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিশুদের ঝরে পড়ার প্রধান কারণ হলো দারিদ্র্য, দারিদ্র্যের কষাঘাতে বাংলাদেশের শিশুদের প্রাণ আসে আর যায়। লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার মতো খরচ বাবা-মা বহন করতে পারে না বলে তারা স্কুল ত্যাগ করে।
২. শিশুশ্রম : প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিশুদের ঝরে পড়ার অন্যতম একটি প্রধান কারণ হলো শিশুশ্রম। শিশুরা শিশুশ্রমে জড়িত হয়ে পড়ার কারণে স্কুল ত্যাগ করে। প্রতিদিন শিশুরা কাজ করলে প্রায় ৩০/৪০ টাকার মতো পেয়ে থাকে। দরিদ্র পিতা-মাতা মনে করে ৩০/৪০ টাকা তাদের নিকট অনেক কিছু। তাই তারা শিশুর স্কুলে গমনাগমন বন্ধ করে দেয়।
৩. অমনোযোগিতা : শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার এটি একটি অন্যতম কারণ। অধিকাংশ শিশুরা অমনোযোগী। তাই তারা শিক্ষার মধ্যে কোন আনন্দ না পেয়ে স্কুল ত্যাগ করে।
৪. অহেতুক ভয় : অধিকাংশ শিশুদের মনে অহেতুক ভয় কাজ করে। তারা শিশুকে খুব ভয় পায় এবং মনে করে পড়া না পারলে শিক্ষক তাকে কঠোর শাস্তি দেবেন। তাই তারা স্কুলে যাওয়া চিরতরে বন্ধ করে দেয়।
৫. শিক্ষকদের আচরণ : শিশুদের স্কুল ঝরে পড়ার অন্যতম একটি কারণ বিদ্যালয়ে এমন অনেক শিক্ষক আছেন যারা শিশুদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের সাথে চোখ রাঙিয়ে কথা বলেন। এতে শিশুরা ভয় পায় এবং স্কুল ত্যাগ করে।
৬. ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা : বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। এখানে শিশুদের জন্য প্রায় ডজনখানেক পাঠ্যবই রাখা হয়। যেসব বইপুস্তক আছে তার সঠিক মূল্যায়ন নেই। ছোট শিশুরা ডজনখানেক বই দেখে ভয় পায় এবং স্কুলে যেতে অপারগতা প্রকাশ করে। শিক্ষার মধ্যে কোন আনন্দ না পেয়ে শেষে স্কুলের দরজা চিরতরে বন্ধ করে দেয়। সুতরাং বলা যায়, বিদ্যালয় থেকে শিশুদের ঝরে পড়ার জন্য অনেক কারণই দায়ী তবে এর মধ্যে দারিদ্র্যতাই প্রধান ভূমিকা পালন করে।

প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে গৃহীত ব্যবস্থা : প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ব্যবস্থাসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. দরিদ্র ছেলেমেয়েদের জন্য উপবৃত্তি সম্প্রসারণ করতে হবে।
২. স্কুলের পরিবেশ আকর্ষণীয় ও আনন্দময় করে তোলা হবে। এই লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের জন্য খেলাধুলার সুব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের আগ্রহ, মমত্ববোধ ও সহানুভূতিশীল আচরণ এবং পরিচ্ছন্ন ভৌত পরিবেশসহ উল্লেখযোগ্য উপকরণের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। ছেলেমেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্পন্ন পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে। শারীরিক শাস্তি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা হবে।
৩. দুপুরে খাবার ব্যবস্থা করা জরুরি। পিছিয়ে পড়া এলাকাসহ গ্রামীণ সকল বিদ্যালয়ে দুপুরে খাবার ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে চালু করা হবে।
৪. পাহাড়ি এলাকায় এবং দূরবর্তী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের জন্য বিদ্যালয়ে হোস্টেলের ব্যবস্থা করার দিকে নজর দেওয়া হবে।
৫. হাওর, চর এবং একসঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হয় এমন এলাকার বিদ্যালয়ে সময়সূচি এবং ছুটির দিনসমূহের পরিবর্তন করার সুযোগ থাকবে। এসব বিষয়ে স্থানীয় সামাজভিত্তিক তদারকি
ব্যবস্থার সুপারিশে স্থানীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
৬. মেয়ে শিশুদের মধ্যে ঝরে পড়ার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে অধিক হওয়ায় তারা যাতে ঝরে না পড়ে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হবে। মেয়ে শিক্ষার্থীরা যেন বিদ্যালয়ে কোনভাবে উত্যক্ত না হয় তা নিশ্চিত
করা হবে।
৭. বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণি শেষ করার আগে প্রায় অর্ধেক এবং যারা পরবর্তী পর্যায়ে যায় তাদের প্রায় ৪০ শতাংশ দশম শ্রেণি শেষ করার আগে ঝরে পড়ে। ঝরে পড়া দ্রুত কমিয়ে আনা জরুরি। ২০১৮ সালের মধ্যে সকল শিক্ষার্থী যেন অষ্টম শ্রেণি শেষ করে সেই লক্ষ্যে উপযুক্ত পদক্ষেপগুলোসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণ করা হবে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই শিশুদেরকে যদি উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা না যায় অথবা তারা যদি শিক্ষা জীবন শুরু করার আগেই ঝরে পড়ে তবে তা হবে দেশ ও জাতির জন্য সত্যিই ক্ষতিকর। তাই সরকার এ সত্যটি উপলব্ধি করেই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এ ঝরে পড়া প্রতিরোধে কতিপয় যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!