বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবারে পরিবার পরিকল্পনায় সামাজিক বাধা কী?

অথবা, বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়নে সামাজিক প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে তা আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবারের পরিবার পরিকল্পনায় সামাজিক বাধাসমূহ আলোচনা
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশকে জনবিস্ফোরণের দেশ বলা হয়। এ জনবিস্ফোরণের মারাত্মক পরিণতির হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের প্রয়োজন। তাই পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়নে কিছু সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এ প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করে যদি সঠিকভাবে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি কার্যকর করা যায় তবে বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আশানুরূপ অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়নে সামাজিক বাধা : জনসংখ্যা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য অন্যতম প্রধান সমস্যা। তবে এ সমস্যার ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে জনগণ অনেক সচেতন হয়েছে। কলে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবার পরিকল্পনা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাস্তবায়িত অতীত কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে কতিপয় প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করা হয়েছে। নিম্নে এসব প্রতিবন্ধকতা বা বাধাসমূহ উল্লেখ করা হলো :
১. পরিবার পরিকল্পনা সেবার নিম্নমান : প্রচলিত পরিবার পরিকল্পনা সেবাদান ব্যবস্থার নিম্নমান অর্থাৎ কার্যকর পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদানের অভাব। প্রচলিত পরিবার পরিকল্পনা সেবাদান ব্যবস্থা পুনর্সংগঠিত ও কাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজন। যাতে ব্যয় সংকোচনমূলক দক্ষ গুণগতমান সম্পন্ন কার্যকর পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদান করা যায়।
২. স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের যথাযথ ব্যবহারের অভাব : ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র অধিকাংশই অব্যবহৃত বা আংশিক ব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। ডাক্তার, চিকিৎসা সহকারীর অভাব, অপর্যাপ্ত ওষুধ, নিম্নমানের সেবা এবং সেবাউত্তর যত্নের অভাব ইত্যাদি কারণে পরিবার পরিকল্পনা ক্ষেত্রে কেন্দ্রগুলো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
৩. পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণে ত্রুটি : বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণকারীদের সমাজজীবন সম্পর্কিত জ্ঞান যথেষ্ট নয় এবং পরিবর্তনশীল সমাজের গতিপ্রকৃতি অনুধাবনে অপারগতা লক্ষণীয়। বিভিন্ন সমাজের তথ্যাদি নিয়ে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর অপারগতা ও উদাসীনতাই মুখ্যত পরিবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা ডেকে আনে।
৪. অসংগঠিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা : বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা অসংগঠিত ও ত্রুটিপূর্ণ। সর্বস্তরের কর্মীদের মাঝে সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান, যোগাযোগ ও সমন্বয় অনুপস্থিত। অভিজ্ঞতার বিনিময় হয় ঢাকা শহরে অনুষ্ঠিত সম্মেলন, আলোচনা সভার আদলে। পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম সফল না হওয়ার পিছনে প্রশাসনের এরূপ ত্রুটি অনেকাংশে দায়ী।
৫. নারী শিক্ষার অভাব : পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের অগ্রগতির ক্ষেত্রে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু দেখা যায় যে, বাংলাদেশে নারী সমাজ সামাজিকভাবে অবহেলিত এবং প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। পরিবারের আয় উন্নতির ব্যাপারে তাদের বাস্তব ধারণা নেই। এছাড়া পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বামীর সাথে স্ত্রীর সমান অংশ নিতে ব্যর্থ হয়। এতে করে যৌন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পরিকল্পিত পরিবার গঠন সম্ভব হয়ে উঠে না।
৬. বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ : বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এখনো বাল্যবিবাহ প্রচলিত আছে। দেশে আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবে সমাজে বাল্যবিবাহ হয়ে থাকে, যা অধিক সন্তান জন্মদানে উৎসাহ দেয়। এরূপ সামাজিক রীতি পরিবারের আকার নিয়ন্ত্রণে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে।
৭. দরিদ্রতা : বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক দরিদ্র। দরিদ্র লোকেরা সন্তানের আয়ের আশায় সাধারণত অধিক পুত্র সন্তানের প্রত্যাশা করে। তাছাড়া তাদের চিত্তবিনোদনের আর কোনো উপায় না থাকায় দরিদ্র লোকেরা স্ত্রীকে চিত্তবিনোদনের একমাত্র উপকরণ হিসেবে গণ্য করে এবং অধিক সন্তান জন্ম দেয়। আবার অনেক সময় দেখা যায় দারিদ্র্যের কারণে পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রীর পিছনে অর্থ ব্যয় করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই তারা পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে।
৮. মাঠকর্মীদের সামাজিক মর্যাদা : বাংলাদেশে যেসব কর্মী পরিবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে তাদের বেশিরভাগই নিম্নশ্রেণির। ফলে তারা সর্বস্তর ের জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করতে সক্ষম হয় না। এদের প্রতি জনগণের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি করছে।
৯. যোগ্য কর্মী সংকট : আমাদের দেশে পরিবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যারা কাজ করে তাদের অধিকাংশই অদক্ষ। তাই তারা মানসিকভাবে কর্মসূচির সাথে একাত্ম হয়ে নিবেদিত সেবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় না। সুতরাং কর্মীর জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, সংকীর্ণ মানসিকতা ও কাজের অদক্ষতা পরিবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অন্তরায়।
১০. জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সরবরাহ ত্রুটি : জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সঠিক ব্যবহারকারীর কাছে সুষ্ঠু বিলিবণ্টনের ব্যবস্থা না থাকায় কর্মসূচিকে জনপ্রিয় হতে বিঘ্ন ঘটায়। সুতরাং জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সরবরাহে ত্রুটি ও ব্যবহারে জটিলতা কর্মসূচির সফলতার জন্য একটি মারাত্মক সমস্যা।

  • ১১. জটিলতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া : জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহারজনিত জটিলতা কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথে বিরাট অন্ত রায়। কারণ যেসব জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বাংলাদেশে চালু রয়েছে তার প্রায় সবগুলোর কিছু না কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। ফলে অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এ ভয়ে পদ্ধতি গ্রহণে বিরত থাকে।
    ১২. সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা : সরকারিভাবে জনসংখ্যা সমস্যাকে মুখ্য জৈবিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও তা বিভিন্ন আর্থসামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক শর্ত দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু সরকারের জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আর্থসামাজিক মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে উদাসীনতা রয়েছে বলে পরিবার পরিকল্পনা আন্দোলন জোরদার হচ্ছে না।
    উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বহুবিধ প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। জনসংখ্যানীতির সফল বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে জন্মনিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনাকে জাতীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও কতিপয় অসুবিধার কারণে আশানুরূপ সাফল্য অর্জিত হয়নি।