পথ জানা নাই’ গল্পের মূলভাব আলোচনা কর।

উত্তর : মাউলতলা গ্রামের গহুরালিকে এক সকালে দেখা গেল শহরে যাবার সড়কটির গায়ে উন্মত্তের মতো কোদাল চালাতে। প্রচণ্ড আক্রোশে সে সড়কটিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চায়। গ্রামের মানুষ কৌতূহল নিয়ে তার চারপাশে ভিড় জমাল। সে তখন বিড়বিড় করে বলে চলেছে- “ভুল, ভুল অইছিলো এ রাস্তা বানাইন্যা। আমরা যে রাস্তা চাইছেলাম হে এ না।” গহুরালির চাওয়া- পাওয়ার হিসেবের এ গরমিল নিয়েই জমে উঠেছে ‘পথ জানা নাই’ গল্পটি। গহুরালি যে মাউলতলার অধিবাসী এটি দক্ষিণ বাংলার একটি নিভৃত গ্রাম। দীর্ঘদিন পর্যন্ত গ্রামটি ছিল শহরের সাথে সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগশূন্য। তাই এখানে জীবনের ছন্দটি ছিল অনেকটাই ‘প্রাক-পুরাণিক’। আধুনিক যুগে বসবাস করেও ধ্যানধারণা ও চিন্তাচেতনার দিক দিয়ে তারা আটকা পড়েছিল প্রাচীন কালের মধ্যে। মধ্যযুগের অস্ত্রশস্ত্র ছিল তাদের আক্রমণ ও আত্মরক্ষার আয়ুধ। প্রাচীন কৃষি পদ্ধতি অবলম্বন করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ক্ষেতে ক্ষেতে তারা সোনার ফসল ফলাত। ভোগের অধিকার নিয়ে এখানকার পুরুষেরা অনেকটা আদিম প্রথায় পরস্পরের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হতো। জোর করে ধরে আনা নারীকে বিয়ে করে তারা ভালোবাসার সংসার গড়ত, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে এক স্বল্প সন্তুষ্ট ও প্রশান্তিময় জীবনযাপন করতো। এ দীর্ঘ গতানুগতিকতায় আকস্মিকভাবে ছেদ ঘটান জোনাবালি হাওলাদার নামের এক ব্যতিক্রমী মানুষ, চল্লিশ বছর আগে যিনি গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন শহরে। চল্লিশ বছর পর আবার গ্রামে ফিরে এসে গ্রামবাসীদের কাছে তিনি রূপকথার মায়াপুরীর মত আলোকোজ্জ্বল শহরের ছবি মেলে ধরেন। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সমষ্টিগত জীবনের সর্বত্রই পরিবর্তন ও সাফল্যকে সূচিত করতে চাইলে শহরের সাথে যোগাযোগ যে অতি আবশ্যক- তা তিনি গ্রামবাসীদের বুঝাতে সক্ষম হন। রঙিন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে তিনি গ্রামবাসীদের বশীভূত করেন এবং শহরের সাথে যোগাযোগের জন্য একটি নতুন সড়ক নির্মাণ করেন। সেই নয়া সড়ক বেয়ে গ্রামের মানুষ শহরের সান্নিধ্যে আসে। কেউ শহরে যায় বেড়াতে, কেউ যায় চাকরির সন্ধানে। আবার কেউ নিয়োজিত হয় গ্রামের শাকসব্জি শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রির কাজে। দরিদ্র কৃষক গহুরালিও তার জমির উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে শহরের দিকে চলে যাওয়া সড়ক বেয়ে শহর ভ্রমণে যায়। ফিরে আসে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে। তবে শহর তার রোজগারের নতুন পথ খুলে দেয়। তরিতরকারি থেকে শুরু করে গ্রামে সহজ লভ্য নানান জিনিসপত্র শহরে নিয়ে বিক্রি করে সে বেশ খানিকটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করে। খড়ের চালের বদলে টিনের চাল দেখা দেয় তার ঘরে। তবে তার এই সুখের দিন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। শুরু হয় যুদ্ধ আর মন্বন্তর। সড়ক পথ বেয়ে তার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে মাউলতলার জনজীবনেও। জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। বাড়ে মানুষের দুর্ভোগ। গহুরালি এই দুর্দিনে শহর থেকে আসা এক দালালের সংস্পর্শে আসে। গহুরালি ভেবেছিল তার কাছ থেকে সে কিছু উপকার পাবে। কিন্তু ঘটে তার উল্টোটি। এক সকালে উঠে সে তার ঘরের বউকে আর খুঁজে পায় না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানতে পারে যে ঐ দালালের সাথে তার বউ তাকে ছেড়ে শহরে চলে গেছে। মন্বন্তরের উত্তাপে গহুরালির আর্থিক জীবনের নিরাপত্তা আগেই পুড়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল। এবার ভস্মীভূত হয় তার মানসিক শান্তিটুকুও। অন্তরে বাইরে নিঃস্ব গহুরালি তার এই দারুণ দুর্দাশার জন্য পুরোপুরিভাবে দায়ী করে শহরের সাথে সংযোগ সাধনকারী নতুন সড়কটিকে। তাই উন্মত্ত আক্রোশে সড়কটি কোপাতে কোপাতে গহুরালি সবাইকে জানায় এই সড়কটি নির্মাণ করা খুব ভুল হয়েছিল। কিন্তু কী করলে ঠিক হতো এ প্রশ্নের উত্তর যেমন গহুরালির জানা নেই তেমনি অজানা রয়েছে গ্রামের সকলেরই।