নারী নেত্রী ইলা মিত্র সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, নারী নেত্রী ইলা মিত্রের অবদান আলোচনা কর।
অথবা, নারী নেত্রী ইলা মিত্রের অবদান বর্ণনা কর।
অথবা, নারী নেত্রী ইলা মিত্রের অবদান ব্যাখ্যা কর।
অথবা, নারী নেত্রী ইলা মিত্র সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
নাচোলের সাঁওতাল ও বাঙালি কৃষকদের মিলিত সংগ্রাম তৈরি করেছে তার নেতৃত্বকে, যার পুরোভাগে ছিলেন রমেন্দ্রনাথ মিত্র, ইলা মিত্র, মাতলা মাঝি প্রমুখ। তেমনি এ নেতৃত্বের এবং তাদের ঊর্ধ্বতন পার্টি। নেতৃত্বের ভূমিকা নির্ধারণ করেছে এ বিদ্রোহের ফলাফল। এদের মধ্যে অনেক কারণ মিলিয়ে বিশেষত ইলা মিত্রের ভূমিকা হয়ে উঠেছিল অনেকটা নির্ধারণ, যার প্রতিফলন পাওয়া যায় সাঁওতাল কৃষকের কাছে তার ‘রানী মা’ হয়ে উঠার মধ্যে।
ইলা সেন হতে ইলা মিত্র : ইলা মিত্রের পৈতৃক পদবি ছিল ‘সেন’। ইলা মিত্র কলকাতার পাবলিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশনে লেটার নিয়ে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। পরে পর্যায়ক্রমে তিনি একই কলেজ হতে বিএ (অনার্স) পাস
করেন। এর ১৪ বছর পর নির্মম পুলিশি নির্যাতন ও কারাভোগ শেষে কলকাতায় ফিরে অদম্য মনোবলের জোরে ১৯৫৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেছিলেন। ইলা সেন বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে তার পৈত্রিক পদবি সেনকে বিলুপ্ত করে স্বামীর পদবি মিত্র গ্রহণ করেন।
নারী নেত্রী ইলা মিত্রের অবদান : নারী নেত্রী হিসেবে ইলা মিত্রের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি রেখে গেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান। এগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. ক্রীড়াবিদ ইলা মিত্র : স্কুলে পড়ার সময় হতেই লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায় প্রচণ্ড আগ্রহী ছিলেন ইলা মিত্র। তিনি শৈশবেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন কৃতি ক্রীড়াবিদ হিসেবে। ১৯৩৬-৩৮ পর্যন্ত একটানা তিন বছর তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের জুনিয়র এ্যাথলেটিক্সে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। সে সময় এ্যাথলেটিক্সে বাঙালি মেয়েদের অংশগ্রহণ প্রায় ছিল না বললেই চলে। কিন্তু ব্যতিক্রমী ইলা মিত্র ইউরোপিয়ান ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের রেকর্ড ভেঙে ১০০ মিটার দৌড়ে সর্বভারতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এরই সুবাদে ১৯৪০ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকেও অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
২. রাজনীতিবিদ ইলা মিত্র : পড়াশুনা ও খেলাধুলার পাশাপাশি ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। রাজনীতিতে তার কর্মকাণ্ড ছিল নিম্নরূপ :
ক. কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট : ইলা মিত্র ১৯৪১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গীভূত সংগঠন ‘Girls Store Committee’ কাজে যুক্ত হন। মার্কসবাদ সম্পর্কে পড়াশুনা এ সময়ই শুরু করেন এবং এভাবেই ধীরে ধীরে বামপন্থি রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। কেন হন, এর উত্তরে তিনি বলেছেন, “কারণ কমিউনিস্টরা সমাজকে পরিবর্তন করতে চায়, অন্যদিকে মানুষের সেবাও করতে চায়। এ দুটি দিকই আমাকে খুব আকৃষ্ট করে।”
খ. ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রভাব : ১৯৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রবল জোয়ার আই. এ পড়ুয়া ছাত্রী ইলা সেনের মনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ তাকে আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করে। বাংলার প্রগতিশীল ছাত্রছাত্রীরা সেকালে যুক্ত হতেন ‘ছাত্র ফেডারেশনে’র সাথে। ইলা সেনও কলেজ জীবনের গোড়াতেই ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হন। তাই ভারত ছাড় আন্দোলনে ইলা মিত্র সংশ্লিষ্ট হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
গ. মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গঠন : ১৯৪৩ সালে বেথুনের কলেজে বি.এ পড়ার সময় ইলা সেন মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সদস্য হন। এ সমিতির জন্ম হয়েছিল একটি বিশেষ প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে। ব্রিটিশ সরকার ২২ জুলাই ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে মহিলা ফ্রন্ট গঠিত হয়। অতঃপর মহিলা ফ্রন্ট কর্তৃক সম্ভাব্য জাপান ি আক্রমণের বিরুদ্ধে ও অন্যান্য নানাবিধ যুদ্ধকালীন সংকট থেকে মেয়েদের আত্মরক্ষামূলক কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে নারীসমাজের মুক্তির প্রশ্নটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গঠিত হয়। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির উদ্দেশ্য ছিল—
১. দেশরক্ষা,
২. জাতীয় নেতাদের মুক্তি ও জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা,
৩. দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ ও নারীদের মর্যাদার সাথে বাঁচতে সাহায্য করা,
৪. সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শামিল হওয়া।
চ. তেভাগা আন্দোলনে ইলা মিত্র : ইলা মিত্রের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল বাংলার কৃষক শ্রেণির পাশে এসে দাঁড়ানো। তিনি তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি বিয়ের সুবাদে ইলা মিত্র হয়ে চাপাইনবাবগঞ্জের প্রভাবশালী ভূস্বামী পরিবারের বধূ হয়ে এসে শ্বশুরবাড়ির সামন্ত সংস্কৃতির বেড়াজালে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বসে থাকেননি, তেভাগা আন্দোলনের মাধ্যমে ভূস্বামী, জমিদার ও জোতদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যান। তার আন্দোলনে ব্রিটিশ প্রশাসনও ভারতবর্ষে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং কৃষকদের অধিকার আদায়ে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
৩. সাহসিকতায় ইলা মিত্র : ইলা মিত্র ছিলেন অত্যন্ত সাহসী রমণী ও নারী সংগঠক। তার রাজনৈতিক তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের নজর পড়ে তার উপর। পুলিশ বিভিন্ন সময়ে ইলা মিত্রকে গ্রেফতার করার জন্য চেষ্টা করলেও তার উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার জন্য পুলিশকে বোকা বানিয়ে ছেড়েছে। তার এ আত্মরক্ষার ঘটনা সম্পর্কে হেফাজ আলী মাস্টার বলেছেন, “এভাবে আত্মরক্ষা কোন মেয়ে কেন, পুরুষের পক্ষেও ছিল দুঃসাধ্য।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইলা মিত্র ছিলেন নারী আন্দোলনের অগ্রদূত ও প্রেরণা। নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ আর ইলা মিত্রের নাম এত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে, ইলা মিত্র হয়ে উঠেছেন ঐ বিদ্রোহের মূর্ত প্রতিনিধি। তার ভূমিকা নিশ্চিতভাবেই অনেকাংশে নির্ধারণ করেছে নাচোল কৃষক জাগরণের অবয়ব। ইলা মিত্র তেভাগা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ ছিল তেভাগা আন্দোলনের একটি পরিবর্ধিত অংশ এবং তেভাগা আন্দোলন ছিল ফসলের অর্ধাংশের বদলে দুই-তৃতীয়াংশ লাভের জন্য ভাগচাষিদের আন্দোলন। তাছাড়া পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় নানাবিধ প্রথা আর সংস্কার কুসংস্কারের বেড়াজাল ডিঙিয়ে এসে এসব ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজন ছিল অদম্য মনোবল আর সাহসের। ইলা মিত্রের ক্ষেত্রে তার অভাব হয়নি।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%be-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf/