UNESCO -র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি? বাংলাদেশে ইউনেস্কোর ভূমিকা ব্যাখ্যা কর।

উত্তর : ভূমিকা ও জাতিসংঘের অন্যতম বিশেষায়িত সংস্থা হচ্ছে UNESCO। জাতিসংঘের সনদে বিশ্ববাসীর সাংস্কৃতিক জীবনের সামগ্রিক উন্নয়ন ও বিকাশের সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ ঘোষণা বাস্তবায়নে মানবজাতির শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রক্ষা ও বিকাশে এ সংস্থার জন্ম । জাতিসমূহের মধ্যে শিক্ষা, বিজ্ঞান সংস্কৃতির সম্প্রসারণ, মানব সম্পদ উন্নয়ন, বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞ বিনিময় ঐতিহ্য ও স্মৃতি সংরক্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে UNESCO ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিতে ইউনেস্কো বিরাট অবদান রেখে চলছে।
→ ইউনেস্কোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঃ ইউনেস্কোর প্রাথমিক ও মূল লক্ষ্য হচ্ছে জাতিসমূহের মধ্যে শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা আনয়ন। নিম্নে UNESCO -র লক্ষ্য ও
উদ্দেশ্যসমূহ তুলে ধরা হলো :
১. শিক্ষা, বিজ্ঞান, ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে জাতিসমূহের সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
২. জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, নির্বিশেষে সকল মানুষের মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
৩. বিশ্বজুড়ে সকল গণমাধ্যমের ব্যবহারের মাধ্যমে পারস্পরিক জ্ঞান ও ধারণার আদান-প্রদান করা।
৪. জাতিসমূহের পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
৫. সদৃশ্য দেশগুলোকে তাদের অনুরোধের ভিত্তিতে শিক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রমের উন্নয়ন সহায়তা করা।
৬. আন্তর্জাতিক কনভেনশনের মাধ্যমে দেশসমূহের বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য বই শিক্ষাকর্ম, বিজ্ঞান ও ইতিহাস নিদর্শন সংরক্ষণের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত জ্ঞানের বিকাশ সাধন করা।
৭. শিক্ষা, বিজ্ঞান, ও সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যক্তি এবং সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকাশনা, সাহিত্য ও বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিভিন্ন বস্তু ও অন্যান্য দ্রব্য ও তথ্যাদির আদান-প্রদানের মাধ্যমে দেশগুলো বুদ্ধিভিত্তিক উন্নয়নে তাদেরকে উৎসাহিত করা।
৮. শিশুদের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট শিক্ষা পদ্ধতির জন্য সদস্য দেশগুলোকে প্রস্তাব প্রদান করা ।
৯. বিভিন্ন দেশের প্রকাশনায় অন্যান্য দেশগুলোকে অংশগ্রহণের সুযোগের মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচার ও প্রসার সাধন করা।
→ বাংলাদেশে ইউনেস্কোর ভূমিকা ঃ জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে ইউনেস্কো বাংলাদেশে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো :
১. শিক্ষা উন্নয়ন ঃ শিক্ষা অন্যতম মৌল মানবিক অধিকার যা মানবজাতির আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক
বিকাশ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম-শিক্ষা ক্ষেত্রে UNESCO-র অবদান অনস্বীকার্য। নিম্নে বাংলাদেশে ইউনেস্কোর শিক্ষা উন্নয়নের বিভিন্ন তুলে ধরা হলো :
(ক) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঃ UNESCO-র সহায়তায় দেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষা প্রসারে অগ্রণী
ভূমিকা পালন করছে।
(খ) নিরক্ষরতা দূরীকরণ ঃ বিশ্বকে অজ্ঞতা ও নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে ইউনেস্কো সদা তৎপর। এজন্য বিশ্বব্যাপী সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, গণশিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, স্থানীয় শিক্ষা প্রভৃতি ব্যবস্থাকরণের মাধ্যমে নিরক্ষরতামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে UNESCO ব্যাপক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
(গ) প্রশিক্ষণ : ইউনেস্কো বাংলাদেশে শিক্ষা উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করে থাকে। যেমন- বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা প্রশাসন ব্যবস্থা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, ঢাকা ইত্যাদি।
(ঘ) শিক্ষা উপকরণ ঃ শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে ইউনেস্কো শিক্ষা উন্নয়নের ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে যেসকল ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে যেমন- পুস্তক সরবরাহ, সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা, খাতা-কলম, পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, শিক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ ইত্যাদি।
(ঙ) আর্থিক সহায়তা ঃ শিক্ষার উন্নয়নে প্রসার ঘটানোর জন্য UNESCO বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে।
(চ) গবেষণা : ইউনেস্কো শিক্ষা সংক্রান্ত ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গবেষণার কাজে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। UNESCO মানবিক, দর্শন, কলা, ইতিহাস, সমাজ ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান উন্নয়ন, বর্ণবাদ, যুদ্ধ, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণায় সহযোগিতা করে থাকে।
(ছ) শিক্ষার মান উন্নয়ন ঃ শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নই ইউনেস্কোর লক্ষ্য। এজন্য সকলের সমান শিক্ষার সুযোগ প্রদান, জ্ঞান ও ধারণার স্বাধীন বিনিময়, মানবিক ও সামাজিক আচরণ এবং মানবাধিকার শিক্ষা, ছাত্র-ছাত্রী শিল্পী ও বিজ্ঞানীদের বিনিময় এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণ নৃ-বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও সমাজবিদ্যার কৌশল যোগ, সৃজনশীল কলা, বিজ্ঞানে উৎসাহ প্রদান, দেশজ সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন, আন্তর্জাতিক স্খলন, সেমিনার, ক্যাম্প শিশু ভিলেজ ইত্যাদির ব্যবস্থা করে থাকে।
২. বিজ্ঞান ঃ বিজ্ঞানের বিকাশ ও উন্নয়ন সাধনে ইউনেস্কো বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। এর মাধ্যমে ভূ-বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, জনবিজ্ঞান, সমুদ্রবিদ্যা, গণিত,.জীববিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ, আন্তঃসরকার সমুদ্র ও জল অনুসন্ধান এবং ভৌগোলিক আন্তঃসম্পর্ক প্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যেমন : অণুজীববিজ্ঞান কর্মশালা ও কেন্দ্র। তাছাড়া বাংলাদেশে UNESCO সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। যেমন- জাতিগত উত্তেজনা, বর্ণবাদ ও বর্ণ বৈষম্য, উন্নয়নের আর্থ-সামাজিক দিক, মানুষ ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ে
গবেষণা করে।
৩. সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ঃ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ. সৃজনশীলতার বিকাশ, সৃষ্টিশীল কলা ও
সাহিত্যের উন্নয়নে ইউনেস্কো তার আন্তর্জাতিক কর্তব্যের অংশরূপে বাংলাদেশে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে চালিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো নিম্নরূপ :
(ক) সংগীত, সাহিত্য, ললিতকলা, রঙ্গমঞ্চ প্রভৃতির উন্নয়ন সাধন।
(খ) ঐতিহ্যবাহী স্মারক স্থান, বস্তু, মূর্তি ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক নিদর্শন সংরক্ষণে ইউনেস্কো উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। যেমন- বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, সুন্দরবন প্রভৃতি।
(গ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংগীত, নাট্যমঞ্চ, যাদুঘর, পাঠাগার পুরাকীর্তি, ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ ইত্যাদি পুনরুদ্ধার ও সংস্কারে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান। যেমন- সোনারগাঁও, সুন্দরবন, মহাস্থান গড় ইতাদি।
(ঘ) এর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড শৈল্পিক সৃজনশীলতা, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, শিল্পকর্ম, ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত। যেমন- বাংলাদেশে জাতীয় বিজ্ঞানে ও যাদুঘরের উন্নয়ন।
(ঙ) বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতির ভাষা সংরক্ষণে ইউনেস্কোর অবদান অনস্বীকার্য। যেমন- ইউনেস্কোর সক্রিয় প্রচেষ্টায় ১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯ বাংলাদেশের ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে গণ্য হয়েছে।
৪. যোগাযোগ, তথ্য ও তথ্যবিদ্যা ঃ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি যোগাযোগ, তথ্য ও তথ্যবিদ্যার ক্ষেত্রে UNESCO গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইউনেস্কোর অবদানে বাংলাদেশে পারস্পরিক সহযোগিতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত আদান-প্রদান, পারস্পরিক বৈষম্য কমিয়ে আনা এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধন রচনায় যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫. মানবিক বিষয় ঃ ইউনেস্কো মানবিক জ্ঞানের প্রসারের ক্ষেত্রে সকল প্রকার বিভাজনের প্রাচীর ভেঙ্গে দেয়ার লক্ষ্য। এই কারণে সকল জ্ঞানের ঐক্য সাধনই তার লক্ষ্য। জাতিগত বিদ্বেষ ও ব্যবধানের অবসান ঘটানো প্রযুক্তির বিকাশের সামাজিক ফলাফলের প্রতি ইউনেস্কো দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
৬. নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা ঃ ইউনেস্কো নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় বিশেষ প্রশিক্ষণ, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তির যোগাযোগ সৃষ্টিকারী কম্পিউটার নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠাও একে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্তকরণকে গুরুত্বদান করে থাকে ।
৭. প্রকাশনা ঃ মৌলিক শিক্ষা, গবেষণা, শিক্ষা সাময়িকী ইএফএ বিশ্ব নজরদারি, প্রতিবেদন, শিল্পকলার ইতিহাস, তথ্য কেন্দ্র খোলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে UNESCO কাজ করে চলছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রকাশনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, জাতিসংঘের একটি বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে UNESCO বিশ্বব্যাপী তার কর্মসূচি প্রণয়ন করে থাকে। যা দ্বারা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রয়াস পাচ্ছে। উদাহরণের স্বরূপ বলা যায় ১৯৯৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ইউনেস্কো বাংলাদেশের ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস”
হিসেবে ঘোষণা করে । যা বিশ্ব দরবারে বাঙালি জাতির সুনাম অর্জনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।